Advertisement
E-Paper

ঝকঝকে সেতুর আড়ালে ছিতামুনির ভাঙাচোরা ঘর

স্কুল-কলেজ, রাস্তা-সেতু, দু’টাকা কেজির চাল। তবু দুর্নীতি ও বঞ্চনার অভিযোগে ফের শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সূচনা। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের হাওয়া। লাল মাটি উড়ছে জঙ্গলমহলে। আজ প্রথম কিস্তি। স্কুল-কলেজ, রাস্তা-সেতু, দু’টাকা কেজির চাল। তবু দুর্নীতি ও বঞ্চনার অভিযোগে ফের শাসকের বিরুদ্ধে ক্ষোভের সূচনা। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণের হাওয়া। লাল মাটি উড়ছে জঙ্গলমহলে। আজ প্রথম কিস্তি।

সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭ ০৪:১৪
লালগড়ে কাঁটাপাহাড়ি মোড় থেকে সিজুয়া গ্রামে যাওয়ার রাস্তার এই হাল। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

লালগড়ে কাঁটাপাহাড়ি মোড় থেকে সিজুয়া গ্রামে যাওয়ার রাস্তার এই হাল। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।

সন্ধ্যা নামার পরেও সদর ফটক হাঁ করে খোলা। মোটর বাইকে, সাইকেলে কিংবা হেঁটে স্থানীয় লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে অবাধে। প্রবেশপথের মাথায় দু’টো সেন্ট্রি পোস্ট আছে বটে, তবে সেন্ট্রি নেই। ল্যান্ডমাইন নিরোধক গাড়ি, জংলা পোশাকে পুলিশ বা আধা সামরিক ফৌজের পদচারণাও চোখে পড়ল না। কে বলবে, এটাই সেই লালগড় থানা!

ন’বছর আগের সেই আন্দোলন এখন অতীত মাত্র। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সম্প্রতি বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর, ইঁদপুর ও পুরুলিয়ার কোটশিলায় গিয়ে বলেছেন, একটা সময়ে যেখানে রক্ত ঝরত, মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত থাকতেন, সেই জঙ্গলমহলে এখন শুধুই শান্তি।

অতএব লালগড়-সহ জঙ্গলমহল এখন শীতকালের কংসাবতীর মতোই তরঙ্গহীন। এবং মস্ত বড় ভুলটা এখানেই। পরিস্থিতি শান্ত মানেই মানুষের ক্ষোভ যে উধাও, তা কিন্তু নয়। যে ক্ষোভের আঁচ সব চেয়ে বেশি পাওয়া গেল লালগড়ের সিজুয়া তথা কাঁটাপাহাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতে। যা ছিল লালগড় আন্দোলনের গর্ভগৃহ।

তৃণমূলের লালগড় ব্লক সভাপতি খোদ বনবিহারী রায় স্বীকার করে নিচ্ছেন, ‘‘এলাকার বহু দরিদ্র মানুষ প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধে থেকে বঞ্চিত। পঞ্চায়েতের দুর্নীতি নিয়ে বাসিন্দাদের বিস্তর অভিযোগ। আমি বহু বার বলেছি, কাজ হয়নি।’’ ছোটপেলিয়া গ্রামে পুলিশের হাতে আদিবাসী মহিলাদের প্রহৃত হওয়ার অব্যবহিত পরেই লালগড় আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পুলিশের রাইফেলের কুঁদোয় থেঁতলে গিয়েছিল ছিতামুনি মুর্মুর বাঁ চোখ। আজও তাঁর মাটির কাঁচা ঘরে খড়ের চাল ভেদ করে বর্ষায় ঝরঝরিয়ে জল পড়ে। তবু গীতাঞ্জলি বা প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘর বরাদ্দ হয়নি ওই পরিবারের জন্য। ছিতামুনির স্বামী, ভঙ্গুর স্বাস্থ্যের প্রৌঢ় গোরাচাঁদের কথায়, ‘‘পরিবর্তনে আমাদের কোনও পরিবর্তন নাই।’’

এলাকাবাসীর অনেকেরই অভিযোগ, সরকারি আবাস প্রকল্পে ঘর পেতে গেলে বহু ক্ষেত্রে হতদরিদ্র মানুষকে আট-দশ হাজার টাকা দিতে হয়, যা ঢোকে শাসক দলের স্থানীয় কয়েক জন নেতার পকেটে। নয়াগ্রামের বালিগেড়িয়া অঞ্চলের বাঁশকুঠি গ্রামের অচিন্ত্য নায়েকের অভিযোগ, তিনি শাসক দলকে ‘কমিশন’ দিতে অস্বীকার করায় ইন্দিরা আবাস তৈরির শেষ কিস্তির আট হাজার টাকা পাননি।

ক্ষোভের বারুদ জমছে ১০০ দিনের কাজ নিয়েও। বালিগেড়িয়ার কুসুমকুঠি গ্রামের কৃষক, খেতমজুর ফাগুরাম বেসরা জানান, তিন বছর আগে ১০০ দিনের কাজে আকাশমণি গাছের চারা লাগানোর কাজ ২৮ দিন করেছিলেন তিনি, তাঁর মা, স্ত্রী ও ভাই। সেই সব চারা এখন বৃক্ষ, তবে চার জনের কেউই একটা পয়সা পাননি। কাঁটাপাহাড়ির বরাগাদা মৌজার ধানঘরি গ্রামে নির্মল মুর্মুর এক বিঘে পাঁচ কাঠা জমিতে পুকুর কাটার কাজ হয়েছিল গত এপ্রিল-মে-তে। কিন্তু ১৫ দিনে যা কাজ হয়েছে, তাতে সেটা আদৌ পুকুর হয়নি। অথচ ওই জমিতে আর চাষও করা যাবে না। ক’জন কাজ করেছেন, কত টাকার কাজ হয়েছে এই সব তথ্য সম্বলিত বোর্ডও সেখানে টাঙানো নেই, অর্থাৎ স্বচ্ছতার অভাব প্রকট।

নয়াগ্রামের চন্দ্ররেখা অঞ্চলের রাইপাল গ্রামের লঘুচরণ মাণ্ডির কথায়, ‘‘যার এক ছটাক জমিও নেই, পঞ্চায়েতের খাতায় সে এপিএল। আর ২৫ বিঘা জমির মালিক কি না বিপিএল! পরিবর্তন মানে বড়লোকরা আরও বড়লোক। গরিবরা গরিব।’’ স্থানীয় বিধায়ক, নয়াগ্রামে তৃণমূলের ব্লক সভাপতি দুলাল মুর্মু বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েতে দুর্নীতির কথা আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখব।’’

প্রতিটি ঘরে অবশ্য ফি সপ্তাহে ঢুকছে দু’টাকা কেজির চাল। বহু মোরাম রাস্তা পিচের হয়েছে আর কাঁচা রাস্তা মোরামের। লম্বা-চওড়া নতুন নতুন সেতু কম সময়ে জুড়ছে দু’প্রান্তকে। এ সবের সঙ্গে স্কুল-কলেজ-হস্টেলের সাদা-নীল রঙের চার-পাঁচতলা ভবন দাঁড়িয়ে আছে হাস্যমুখর জঙ্গলমহলের ঝলমলে বিজ্ঞাপন হিসেবে। তবু তার গায়ে কালো পোঁচ লাগিয়ে দিচ্ছে পঞ্চায়েত স্তরে লাগামহীন দুর্নীতি। ফিরে আসছে আগের আমলের বঞ্চনা ও স্বজনপোষণের সেই পুরনো ছবিটাই।

কিন্তু মানুষের এই ক্ষোভকে কাজে লাগাতে পারবে কোন বিরোধী দল? লালগড়ে একদা ঝাড়খণ্ড পার্টি শক্তিশালী ছিল। এখন অবশ্য তারা নিতান্তই দুর্বল। কংগ্রেসের উপস্থিতি নেই বহু যুগ ধরে। আর সিপিএম? ঝাড়গ্রামে দলের জেলা সম্পাদক ডহরেশ্বর সেন মানছেন, ‘‘পঞ্চায়েতে তৃণমূলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আছে ঠিকই, তবু বামপন্থীরা নির্ভরযোগ্য বিরোধী শক্তি হিসেবে এখনও এখানে তৈরি হতে পারেনি।’’ তা ছাড়া, বাম আমলের দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, দমন-পীড়নের স্মৃতিও মোছেনি মানুষের মন থেকে। ডহরেশ্বরবাবু বলেন, ‘‘ঝাড়গ্রাম জেলার বহু এলাকার মানুষ এখন বিজেপি-র সমর্থনে প্রচার করছেন। কেউ গোপনে, কেউ প্রকাশ্যে।’’

(চলবে)

Lalgarh Jangalmahal Corruption Deprivation Facilities Poor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy