চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগে তমলুক জেলা হাসপাতালের এক চিকিৎসককে পাঁচ লক্ষ টাকার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিল রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালত।
পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদলের বাসিন্দা, পেশায় নার্স পাপিয়া হাজরা ২০০৭ সালের ৭ মে সন্তান প্রসবের জন্য তমলুক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, সারা রাত প্রসববেদনা উঠলেও কর্তব্যরত চিকিৎসক যুগলচন্দ্র মাইতি হাসপাতালে আসেননি। পাপিয়া হাজরার স্বামী সুনির্মল হাজরার অভিযোগ, পরদিন সকালে চিকিৎসক যখন হাসপাতালে আসেন তখন তাঁর স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। তড়িঘড়ি চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করেন। পরদিন বাচ্চাটি মারা যায়। এরপর ১১ মে রোগীকে ছুটি দেওয়া হয়। পাপিয়াদেবী বলেন, ‘‘বাড়ি যাওয়ার দু’দিন পর লক্ষ করি, আমার যোনিপথ দিয়ে মল বের হচ্ছে।’’ শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পাপিয়াদেবীকে কলকাতার রামকৃষ্ণ সেবা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করেন তাঁর পরিবারের লোকেরা। ওই হাসপাতালে তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকার পর বাড়ি ফেরেন পাপিয়া। কিন্তু ওই ঘটনার আট বছর পরেও হলেও এখনও পুরোপুরি সুস্থ হননি পাপিয়াদেবী। তাঁর দাবি, ‘‘এখনও বেশিক্ষণ প্র্রস্রাবের বেগ ধরে রাখতে পারি না।’’ বর্তমানে খেজুরি দুই নম্বর ব্লকে উপস্বাস্থ্যকেন্দ্রে কর্মরত পাপিয়াদেবী। তিনি বলেন, ‘‘চিকিৎসক যুগলচন্দ্র মাইতির গাফিলতির জন্যই আমার সন্তানকে হারিয়েছি। চিকিৎসকের ভুলেই আমাকে এখনও অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে।’’
চিকিৎসকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ এনে ২০০৮ সালে পাপিয়াদেবী পূর্ব মেদিনীপুর জেলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করেন। ২০১২ সালে জেলা আদালত চিকিৎসককে সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের নির্দেশ দেয়। জেলা আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক রাজ্য ক্রেতা আদালতে মামলা করেন। রাজ্য ক্রেতা আদালত সম্প্রতি জানিয়েছে, ওই চিকিৎসকের গাফিলতিতেই পাপিয়াদেবীকে ভুগতে হয়েছে। বিচারক কালিদাস মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ডাক্তার চিকিৎসাশাস্ত্র ও চিকিৎসা পদ্ধতি মেনে চলেননি। তাই ভুগতে হয়েছে রোগীকে। চিকিৎসার গাফিলতির জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ তাঁকে পাঁচ লক্ষ টাকা রোগীর পরিবারকে দিতে হবে।’’
রাজ্য ক্রেতা আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ইতিমধ্যেই জাতীয় ক্রেতা আদালতে মামলা করেছেন অভিযুক্ত চিকিৎসক যুগলচন্দ্র মাইতি। যুগলবাবু তমলুক জেলা হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার। কী বলছেন তিনি? যুগলবাবু বলেন, ‘‘যে কোনও অস্ত্রোপচারে জটিলতা হতেই পারে। পাপিয়াদেবীর ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা আমার গাফিলতি নয়। ওনার দুর্ভাগ্য, ওঁর ক্ষেত্রেই এটাই হয়েছে।’’
চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, তমলুক হাসপাতালে পাপিয়াদেবীর অস্ত্রোপচারের পর যে অবস্থা হয়েছিল চিকিৎসা পরিভাষায় তার নাম ‘রেক্টো-ভেসিকো-ভ্যাজাইনা-ফিসচুলা।’’ চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, স্ত্রী দেহে মূত্রথলি, জরায়ু ও মলদ্বার খুব কাছাকাছি থাকে। বাচ্চা বের করায় সময় যোনিপথের বাইরের অংশটা খুব সাবধানে কাটতে হয়। যোনিপথ বেশি কাটা হয়ে গেলে রোগীর মূত্রথলি, মলদ্বারে আঘাত লেগে গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি হলে ‘রেক্টো-ভেসিকো-ভ্যাজাইনা-ফিসচুলা’ হতে পারে। পাপিয়াদেবীর ক্ষেত্রে এটাই হয়েছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সোমাজিতা চক্রবর্তী বলেন, ‘‘সন্তান প্রসব করতে গিয়ে রোগী রেক্টো-ভেসিকো-ভ্যাজাইনা-ফিসচুলা শিকার খুব কম মহিলাই হন। এ ব্যাপারে চিকিৎসককে যথেষ্ট সতর্ক থাকতে হয়।’’ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সুদেষ্ণা সাহাও বলেন, ‘‘আগে এই ধরনের জটিলতা গ্রামের দিকে বেশি হলেও, এখন তা অনেকটাই কমেছে। তবে চিকিৎসকদের আরও সতর্ক থাকা উচিত।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy