যন্ত্রণা কাকে বলে, ১৯ বছর আগে ডান হাত হারিয়ে টের পেয়েছিলেন নকুল সিংহ।
আকাশমণির ডাল কাটা পড়লে সেই যন্ত্রণাই যেন তাঁর কাছে ফিরে আসে! মানুষকে তিনি বোঝান— গাছ রক্ষা করতে না পারলে মানব সভ্যতার দুর্গতি ঘনিয়ে আসছে।
মেদিনীপুর শহর থেকে কিলোমিটার চারেক দূরে বাগডুবি গ্রামে থাকেন ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। বাগডুবিতেই বন দফতরের আকাশমণির জঙ্গল পাহারা দেন। ছুঁয়ে দেখেন গাছেদের সংসার। সবুজ ডালপালার বেড়ে ওঠা দেখে শিহরিত হন। গাছ রক্ষার জন্য নকুলবাবুকে প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা সাম্মানিক দেয় বন দফতর।
নকুলবাবুর কথায়, “ডালপালা ভেঙে নিলে গাছ কষ্টের কথা জানাতে পারে না। তবুও গাছ ছায়া দেয়। শুদ্ধ বায়ু ফিরিয়ে দেয়। গাছকে দেখেই আমি বাঁচার প্রেরণা পেয়েছি।’’
১৯ বছর আগে মরেই যাবেন ভেবেছিলেন নকুলবাবু। ১৯৯৮ সালের মার্চের এক দুপুরে দরকারি কাজে মেদিনীপুর শহরে গিয়েছিলেন। বটতলা চকে রাস্তার ধারে মজুত পাথরে হড়কে গিয়েছিল তাঁর সাইকেলের চাকা। সাইকেল সমেত রাস্তায় পড়ে যান তিনি। তখনই ধেয়ে আসা লরির চাকা পিষে দেয় তাঁর ডান হাত। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ভর্তি হন মেদিনীপুর জেলা সদর হাসপাতালে। নকুলবাবুর প্রাণ বাঁচাতে কাঁধ থেকে তাঁর ডান হাতটি কেটে বাদ দেন চিকিত্সক। তাঁকে স্থানান্তরিত করানো হয় কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে। টানা আড়াই মাস সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পরে ছাড়া পান। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন সেই সময়ে। তার পরে নিজেকে সামলে নেন।
আরও পড়ুন: বন্ধুদের বিয়ে রুখে আলেমা ফেরাচ্ছে স্কুলে
ডান হাত হারানোর পরে এলাকার একটি মুরগি খামারে কাজ করতেন নকুলবাবু। বছর খানেক সেই কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। এখন বিঘে পাঁচেক জমিতে এক হাতেই লাঙল চালিয়ে সংসার চলে তাঁর। আর রয়েছে জঙ্গল পাহারা। এক হাতে হ্যান্ডেল ধরে সাইকেল চালিয়ে তিনি জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। শারীরিক বিপর্যয়কে ভুলে থাকেন গাছেদের নিয়ে।
তাঁর স্ত্রী সুমিত্রাদেবীর কথায়, “হাত হারানোর পরে মানুষটা আরও বেশি করে সংসার আর গাছেদের আগলে রেখেছেন।”
বাগডুবি-২ বনসুরক্ষা কমিটির সদস্য রাখাল বেরা বলেন, “একজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করেন নকুলবাবু। ওঁর মনের জোর দেখে আমরা অবাক হয়ে যাই।” নকুলবাবুর প্রশংসা শোনা গিয়েছে ডিএফও (মেদিনীপুর) রবীন্দ্রনাথ সাহার মুখেও। তিনি বলেন, “জঙ্গল রক্ষার কাজে নকুলবাবু যে ভাবে শ্রম দিচ্ছেন, জনসচেতনতার কাজ করছেন, তার কোনও তুলনা হয় না।”
‘গাছই জীবন’— বারবার এই কথাটাই বলেন নবম শ্রেণি পাশ নকুলবাবু।