Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

চেনা গ্রামের চেনা পথে প্রত্যাবর্তন খোকাবাবুর

প্রত্যাবর্তন তো হল ‘খোকাবাবু’র। কিন্তু এ দিন তিনি হয়ে গেলেন ‘সোনার কেল্লা’র মুকুল। শনিবার দুপুর সাড়ে বারোটা। সাংসদ হওয়ার পর প্রথম নিজের নির্বাচনী এলাকায় যাচ্ছেন দেব। সাদা গাড়িটা সবে ইউ-টার্ন নিয়ে ঘাটালের রাস্তায় ঢুকেছে। সানগ্লাস চোখ থেকে নামিয়ে নিজের পোস্টারগুলো দেখতে দেখতে বললেন, “ওই দেখুন, প্রচারের সময় ওই গ্রামে তিনবার এসেছিলাম।”

কেশপুরের চরকা গ্রামে নিহত তৃণমূল নেতা ফিরোজ আলির স্ত্রী লায়লা খাতুন ও ছেলে আনজাদের সঙ্গে কথা বলছেন দেব। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

কেশপুরের চরকা গ্রামে নিহত তৃণমূল নেতা ফিরোজ আলির স্ত্রী লায়লা খাতুন ও ছেলে আনজাদের সঙ্গে কথা বলছেন দেব। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল

ইন্দ্রনীল রায়
ঘাটাল শেষ আপডেট: ২৫ মে ২০১৪ ০২:৩৯
Share: Save:

প্রত্যাবর্তন তো হল ‘খোকাবাবু’র। কিন্তু এ দিন তিনি হয়ে গেলেন ‘সোনার কেল্লা’র মুকুল।

শনিবার দুপুর সাড়ে বারোটা। সাংসদ হওয়ার পর প্রথম নিজের নির্বাচনী এলাকায় যাচ্ছেন দেব। সাদা গাড়িটা সবে ইউ-টার্ন নিয়ে ঘাটালের রাস্তায় ঢুকেছে। সানগ্লাস চোখ থেকে নামিয়ে নিজের পোস্টারগুলো দেখতে দেখতে বললেন, “ওই দেখুন, প্রচারের সময় ওই গ্রামে তিনবার এসেছিলাম।”

পাঁচ কিলোমিটার এগোনোর পর দেখালেন সেই পোলিং বুথ, যেখানে ভোটের দিন দুপুরবেলা এসেছিলেন। সেখান থেকে তৃণমুল অফিসে যাওয়ার পথে দেখালেন কেশপুরের চেনা রাস্তা, যেখানে টানা ৪০ দিনের ভোট-প্রচারে বারবার এসেছেন তিনি। “কিছু বাকি রাখিনি। সব ক’টা ওয়ার্ড, সব ক’টা গ্রাম আমার ঘোরা। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ঘাটাল আমার ঘরবাড়ি হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না,” বিস্কুট খেতে খেতে বলছিলেন দেব। দেখে মনে হচ্ছিল, ঠিক যেন ফেলুদার সঙ্গে রাজস্থানে গিয়ে পূর্বজন্মের চেনা পাড়া খুঁজে পেয়েছে মুকুল।

গাড়ির মিউজিক সিস্টেমে কুমার শানু বাজছে। টলিউডের সুপারস্টার জানালেন, শুক্রবারই শু্যটিং সেরে মুম্বই থেকে ফিরেছেন। রবিবার থেকে আবার শু্যটিং। মাঝে শনিবারটাই শুধু ফাঁকা ছিল। তাই এ দিন ঘাটালে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ‘খোকাবাবু’।

কথা বলতে বলতে গাড়ি পৌঁছল ঘাটাল শহরের ‘দেবালয়’-এ।

ভোটের আগে ৪০ দিন এই সাজানো-গোছানো দোতলা বাড়িটায় দেব থাকতেন। ঘাটালবাসী তাই ভালবেসে বাড়িটার নাম দিয়েছেন ‘দেবালয়’। এ দিন সেখানে দেবের জন্য অপেক্ষা করছিলেন একে ৪৭ হাতে ২৫ জন অফিসার। দেব ঢুকতেই তাঁদের মুখে হাসি। “দেবদা, কত দিন পরে এলে। আমাদের পার্টি দিতে হবে কিন্তু” এ বার সম্মিলিত আবদার নায়কের কাছে।

দুপুরের খাবারে দেবের জন্য এলাহি আয়োজন। ভাত, ডাল, চিংড়ি, মাংস, চাটনি, দই। এক ফাঁকে স্থানীয় কয়েকজন এসে দিয়ে গেলেন মিষ্টি আর সত্যজিৎ রায়ের ‘বিষয় চলচ্চিত্র’। খেতে খেতেই দেব আবদার করলেন, রাতে বাড়ির জন্য একটু গেঁড়ি গুগলি আর কাঁকড়া নিয়ে যেতে চান। সঙ্গে সঙ্গে গেঁড়ি-কাঁকড়ার ব্যবস্থা করতে ছুটলেন কয়েকজন। “৪০ দিন যা দিয়েছি, তা-ই খেয়েছেন। আজই প্রথম দেবদা আবদার করলেন। তাই ব্যবস্থা তো করতেই হবে,” বলছিলেন দেবের রান্নার দায়িত্বে থাকা ঠাকুর। এর মধ্যে দেবের সর্বক্ষণের সঙ্গী উত্তম আর পাপ্পু সব মিলিটারি অফিসারদের খাওয়ালেন। দেবও তাঁদের পিঠে হাত রেখে বললেন, “ভাল করে খাও।”

এ দিন সকালে ‘সাউথ সিটি’-র নতুন ফ্ল্যাট থেকে বেরনোর সময় থেকেই দেব ছিলেন আবেগপ্রবণ। দ্বিতীয় হুগলি সেতু পেরনোর সময় বলছিলেন, ২৭ মার্চ যখন প্রথম ঘাটাল গিয়েছিলেন, তার থেকে ৫৮ দিন বাদে আজ তাঁর মনের অবস্থা কতটা বদলেছে। দেবের কথায়, “সে দিন ভেবেছিলাম, রাজনীতিতে তো এলাম। কিন্তু আমার কেরিয়ারের কী হবে? তারপর ধীরে ধীরে মানুষের দুঃখকষ্ট দেখে বুঝলাম এঁদের পাশে দাঁড়ানো উচিত। আজ জানি ফিল্ম আর রাজনীতি দু’টোই সামলাতে পারবো।” যে মানুষগুলো তাঁকে জেতালেন, তাদের সঙ্গে দেখা না করে তিনি শু্যটিংয়ে মন দিতে পারতেন না বলেও জানালেন ‘শঙ্কর’।

দেব যখন এ সব বলছেন, তখন তাঁর গাড়ি ঘিরে ফেলেছে ঘাটালের বাচ্চাকাচ্চারা। অষ্টম শ্রেণির দুই ছাত্রী এসেছে দেবকে ফুল দিতে। একাদশ শ্রেণির এক ছাত্র আবার অঙ্কের খাতা নিয়ে এসেছিল দেবের সই নিত। একজন আবার তাঁর ছ’মাসের শিশুসন্তানকে দেবের কোলে দিতে উঠেপড়ে লাগলেন। ভালবাসার এই সব অত্যাচার সামলে দেব পৌঁছলেন কেশপুরের চরকা গ্রামে। গত বুধবার এখানেই সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে নিহত হয়েছেন স্থানীয় তৃণমূল নেতা ফিরোজ আলি। এ দিন ফিরোজের স্ত্রী লায়লা খাতুন ও ছেলে আনজাদের সঙ্গে দেখা করেন তিনি, সমবেদনা জানান। ফিরোজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে ছিলেন গাড়িতে। তারপর বলে ওঠেন, “এই হিংসা বন্ধ করতেই হবে। এগুলো দেখলে বড্ড কষ্ট হয় আমার।” বোঝা যায় নায়কের মন বেশ খারাপ। তারপর গ্রামের দিকে তাকিয়ে বলেন, “গ্রামের পলিটিক্সটা আমি বুঝি না। আমি শহরের ছেলে, আমি চাই সবাই মিলে উন্নয়নের পথে হাঁটুক। সেই পথেই এগোতে হবে আমাদের।”

সূর্য ততক্ষণে প্রায় ডুবুডুবু। দেবও গাড়িতে উঠে কেশপুর থেকে রওনা দিলেন ঘাটাল।

ঘাটালে ফিরে সংবর্ধনা সভায় অল্প কিছুক্ষণ থাকলেন। বহু মানুষ ভিড় জমিয়েছিলেন। তাদের সঙ্গে দেখা করতে করতে সময়ই পেলেন না ‘দেবালয়’-এ ফেরার। “কী করব, কলকাতা ফিরতে হবে। এত দেরি হয়ে গেল। গেঁড়ি আর কাঁকড়াই তুলতে পারলাম না,” হাসতে হাসতে বললেন দেব।

ফেরার পথে দেখালেন সে চা দোকানগুলো, যেখান থেকে সন্ধেবেলা সবার জন্য চা আর মুড়ি আসত।

বুঝতে পারলাম ‘মুকুল’ আবার ফিরে এসেছে।

নিজের নির্বাচনী এলাকায় সাংসদের প্রথম সফরের সঙ্গী হিসেবে বুঝতে পারলাম, ঘাটালের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন দেব।

এ-ও বুঝলাম, তাঁর কাছে ঘাটালের মানুষের চাহিদাও অনেক। তবে একটা চাহিদা নাকি পূরণ করতে পারেননি নায়ক!

দেব নিজেও মানলেন, “একটা এক্সপেকটেশনই পূরণ করা হয়নি। ঘাটালের মানুষজন বলেছিলেন, ‘দেবদা তোমার নায়িকাদের তো আনলে না! এটা কি ঠিক করলে?’ আমি বলেছি, তোমাদের সব আশা পূরণের চেষ্টা করবো, কিন্তু হিরোইনদের আনতে বোলো না,” চোখ টিপে ‘সাউথ সিটি’-র ফ্ল্যাটে নেমে গেলেন নতুন এমপি বাবু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

indranil roy deb ghatal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE