ফাঁকা ফুটবল মাঠেই চলছে মেদিনীপুর স্পোর্টসম্যান রিক্রিয়েশন এবং খড়্গপুর কমন স্পোর্টিং ক্লাবের খেলা। ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।
ঝকঝকে স্টেডিয়াম, নীল-সাদা সুদৃশ্য গ্যালারি। মাঠে জেলার অন্যতম সেরা ক্লাব। মফস্সল শহরে ফুটবল-বিনোদনের সব উপকরণই হাজির। নেই শুধু দর্শক। কার্যত ফাঁকা মাঠেই এখন মেদিনীপুর শহরে চলছে জেলা ক্রীড়া সংস্থা পরিচালিত প্রথম বিভাগীয় নক-আউট ফুটবল টুর্নামেন্ট। কোনও দিন ৭০- ৮০ জন দর্শক থাকছে। কোনও দিন আরও কম!
নক-আউট প্রতিযোগিতায় রবিবার মেদিনীপুর স্পোর্টসম্যান রিক্রিয়েশন ক্লাবের মুখোমুখি হয় খড়্গপুর কমন স্পোর্টিং ক্লাব। ৩-০ গোলে জেতে মেদিনীপুর রিক্রিয়েশন। দর্শক-শূন্য মাঠেই চলে খেলা। আজ, সোমবার প্রথম সেমিফাইনালে মুখোমুখি হবে ঝাড়গ্রামের ধাঙ্গরি আদিবাসীপল্লি উন্নয়ন সংস্থা ও মেদিনীপুরের ক্ষুদিরামনগর সুভাষ কর্নার।
অথচ, কয়েক দশক আগেও ছবিটা ছিল অন্য রকম। তখন শহরে ফুটবল ঘিরে উন্মাদনা ছিল যথেষ্টই। জেলার সেরা ক্লাবের খেলা দেখতে মাঠে ভিড় উপচে পড়ত। খেলা শুরুর ২- ৩ ঘন্টা আগে থেকেই স্টেডিয়ামে পিলপিল করে ভিড় হতে শুরু করত। শহরে ফুটবলের সেই উন্মাদনা যে হারিয়ে গিয়েছে তা মানছেন জেলা ক্রীড়া সংস্থার কর্মকর্তারাও। মেদিনীপুর জেলা ক্রীড়া সংস্থার সম্পাদক বিনয় দাস মাল বলেন, “শহরের মানুষের ফুটবল ঘিরে যে আগ্রহ ছিল, তার অনেকটাই ফিকে হয়ে গিয়েছে। তাই এখন মাঠে দর্শক কম হচ্ছে। দর্শক এত কম দেখে আমারও আশ্চর্য লাগছে।” বিনয়বাবুর আশ্বাস, “আমরা চেষ্টা করছি। শহরে হারিয়ে যাওয়া ফুটবল- উন্মাদনা ফিরিয়ে আনতেই হবে।”
কেন এই পরিস্থিতি?
ক্রীড়া-মহলের একাংশ মনে করছে, এর অন্যতম কারণ প্রচারের অভাব। এখন টুর্নামেন্ট ঘিরে শহরে সেই ভাবে প্রচার চালানোই হয় না। একটা সময় ছিল যখন টুর্নামেন্টের বেশ কয়েক দিন আগে থেকে শহর জুড়ে মাইকে ও লিফলেট বিলি করে প্রচার চলত। শহরের বাসিন্দা, প্রাক্তন ফুটবলার অমিয় ভট্টাচার্য বলছিলেন, “এখন খেলার মান নেমে গিয়েছে। ষাট-সত্তরের দশকে স্টেডিয়ামের পাঁচিল টপকে লোক মাঠে ঢুকত। ১০- ১২ পয়সা টিকিটের দাম ছিল। তখন শহরে টুর্নামেন্ট ঘিরে কত আলোচনা হত। আজ কার খেলা আছে, কাল কার খেলা আছে, এ সব নিয়ে চকে চকে চর্চা হত। এখন এ সব হয় কোথায়?” তিনি মানছেন, “খেলা ঘিরে উন্মাদনা তৈরি করতে হলে প্রচারটাও দরকার।”
অমিয়বাবু এক সময় ইস্টবেঙ্গল ক্লাবে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছেন। ক্রীড়া- মহলের একাংশ আবার মনে করে, শহরের ছাত্র- যুবদের মধ্যে এখন ক্রিকেটই জনপ্রিয়। ফুটবলে আগ্রহ খুব কম। তাই স্টেডিয়ামের ওই পরিস্থিতি। রেফারি ইন্দ্রজিৎ পানিগ্রাহীর কথায়, “শহরের ছাত্র- যুবরা এগিয়ে না- এলে এই পরিস্থিতি থেকে বেরোনো অসম্ভব।” রেফারিং করার সুবাদে জেলার বিভিন্ন এলাকায় যান ইন্দ্রজিৎবাবু। তাঁর কথায়, “গ্রামের দিকে ফুটবল ঘিরে যে আগ্রহ আছে শহরে তার নামমাত্রও নেই। গ্রামে টুর্নামেন্ট দেখতে এত লোক আসে যে আমরা মাঠ থেকে সহজে বেরোতেই পারি না। ক’দিন আগে কেশপুরের নেড়াদেউলে একটা টুর্নামেন্ট হল। মাঠের চারপাশে যেন লোক পিলপিল করছিল। শহরে এই উন্মাদনার কথা এখন ভাবাই যায় না।” একই মত জেলা বিদ্যালয় ক্রীড়া সংসদের সম্পাদক সোমনাথ দাসের। তাঁর কথায়, “শহরে অনেকেই মাঠে আসতে চায় না। তাই শহরে ফুটবল খেলার রোমাঞ্চ হারিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-যুবদের মাঠমুখী করাটা জরুরি।” সোমনাথবাবু বলেন, “ফুটবলটা গ্রামেই বেঁচে আছে। শহরের দিকে ফুটবলের ঝোঁক কম। শহরে কোনও টিমে ২০ জন ছেলে খেললে তারমধ্যে ১৫-১৬ জনই তো গ্রামের।”
গত বুধবার থেকে মেদিনীপুর শহরের অরবিন্দ স্টেডিয়ামে শুরু হয়েছে জেলা ক্রীড়া সংস্থা পরিচালিত প্রথম বিভাগীয় নক- আউট ফুটবল টুর্নামেন্ট। চলবে ২০ নভেম্বর। আগেই মহকুমাস্তরে প্রথম বিভাগীয় ফুটবল হয়েছে। মহকুমাস্তরে চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্স দলই জেলাস্তরের এই টুর্নামেন্টে যোগ দিয়েছে। মেদিনীপুর শহরের একমাত্র স্টেডিয়াম এই অরবিন্দ স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটি সংস্কারের অভাবে ধুঁকছিল। গত বছরের গোড়ায় মেদিনীপুরে এসে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্টেডিয়ামের উন্নয়নে অর্থ সাহায্যের কথা ঘোষণা করেন। সেই মতো ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। সংস্কারের পর এখন ঝকঝকে হয়েছে স্টেডিয়াম। নীল-সাদা রং করায় গ্যালারিও সুদৃশ্য হয়েছে। যে স্টেডিয়ামে অনায়াসে ১৫ হাজার লোক বসে খেলা দেখতে পারে, সেখানে ৭০-৮০ জন বসে খেলা দেখছেন, তাও আবার জেলার সেরা ক্লাবগুলোকে নিয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম বিভাগীয় ফুটবল, এটা অনেকের কাছেই বেমানান ঠেকছে। এক সময় শহরে প্রদর্শনী ফুটবল খেলা হত। কলকাতার নামী দলগুলো এসে খেলত। এখন তাও হয় না। কেন ফুটবল মাঠে এখন ভিড় হচ্ছে না? জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ- সভাপতি আশিস চক্রবর্তী মনে করেন, শহরে ক্লাব- ফুটবলের চর্চা কমে যাওয়ার ফলেই এই পরিস্থিতি। তাঁর কথায়, “শহরে ফুটবল উন্মাদনা ফেরাতে হলে ক্লাবগুলোকে নিয়ে টুর্নামেন্ট করতে হবে। আমরা সেই চেষ্টাও করছি।” আশিসবাবু বলেন, “এক সময় এই জেলা সদর শহরে ফুটবল ঘিরে প্রচুর উন্মাদনা ছিল। তখন ক্লাব- ফুটবলের চর্চা ছিল। ফুটবল খেলা দেখতে মাঠে দর্শকদের ভিড় উপচে পড়ত। ক্লাব- ফুটবলের চর্চা যত কমেছে, ভিড়ের ছবিটা ততই ফিকে হয়েছে।” জেলা ক্রীড়া সংস্থার এক সদস্য মানছেন, “ফুটবলের মাধ্যমে যত বেশি লোকজনকে এক জায়গায় আনা সম্ভব, অন্য কোনও মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। আর মেদিনীপুরের মানুষের ফুটবলের উন্মাদনার কথা জানে গোটা জেলার মানুষ। হারানো উন্মাদনা ফেরাতে আমরা কিছু ব্যবস্থাও নিচ্ছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy