Advertisement
E-Paper

৬ জনের মৃত্যুর পরে অভিযান, ফুঁসছে খেজুরি

উপসর্গ ছিল একইরকম। মাথা যন্ত্রণা, ঝাপসা দৃষ্টি, বুকে ব্যথা। গত মঙ্গলবার থেকে একে একে অসুস্থ হয়ে পড়েন খেজুরি-২ ব্লকের খেজুরি গ্রামের বাসিন্দারা। অভিযোগ, চোলাই খাওয়ার পর থেকেই তাঁদের শরীর খারাপ হতে শুরু করে।

সুব্রত গুহ ও আনন্দ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০১:১২
আবগারি দফতর নামমাত্র তল্লাশি চালায়। তারপরও ঠেক বন্ধ হয় না বলে অভিযোগ। তার মাসুল গুনতে হয় প্রাণ দিয়ে। ঠেক ভাঙতে পথে খেজুরি গ্রামের মহিলারা। শনিবার। ছবি: সোহম গুহ।

আবগারি দফতর নামমাত্র তল্লাশি চালায়। তারপরও ঠেক বন্ধ হয় না বলে অভিযোগ। তার মাসুল গুনতে হয় প্রাণ দিয়ে। ঠেক ভাঙতে পথে খেজুরি গ্রামের মহিলারা। শনিবার। ছবি: সোহম গুহ।

উপসর্গ ছিল একইরকম। মাথা যন্ত্রণা, ঝাপসা দৃষ্টি, বুকে ব্যথা।

গত মঙ্গলবার থেকে একে একে অসুস্থ হয়ে পড়েন খেজুরি-২ ব্লকের খেজুরি গ্রামের বাসিন্দারা। অভিযোগ, চোলাই খাওয়ার পর থেকেই তাঁদের শরীর খারাপ হতে শুরু করে। ওইদিনই স্থানীয় জনকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বঙ্কিম দাস (৫৭) নামে এক জনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে শনিবার পর্যন্ত একে একে আরও পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। অসুস্থ অবস্থায় আরও ১৭ জন তমলুকে জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

গত সেপ্টেম্বরে পূর্ব মেদিনীপুরেরই ময়নার আড়ংকিয়ারানা, পেটুয়া বাজারে চোলাই মদের ঠেকে মদ খেয়ে অসুস্থ হয়ে ২৫ জনের মৃত্যু হয়। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলাতেও চোলাই খেয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ২০১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ওই জেলার সংগ্রামপুরে বিষ-মদে ১৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালে তমলুকের কাঁকটিয়া ও রামতারক বাজারে চোলাই খেয়ে ৫২ জনের মৃত্যু হয়। একের পর এক ঘটনার পরেও যে শিক্ষা হয়নি খেজুরিতে চোলাই ঠেক রমরমিয়ে চলার ঘটনাই তার প্রমাণ।

খেজুরির ঘটনায় এখনও পুলিশে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি। কাঁথির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীণ) জাফর আজমল কিদোয়াই বলেন, ‘‘এই ঘটনায় আগে কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও এ বিষয়ে পুলিশকে কিছু না জানিয়েই দেহগুলি দাহ করে দেওয়া হয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘শনিবার জেলা হাসপাতালে মৃত রবি জানার দেহের ময়না-তদন্তের পরই কী কারণে মৃত্যু হয়েছে তা জানা যাবে। প্রকৃত তথ্য জানার পরই পুলিশের পক্ষ থেকে সুয়ো মোটো মামলা রুজু করা হবে।’’ কাঁথির এসডিপিও ইন্দিরা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গতকাল রাত থেকে দফায় দফায় অভিযানে খেজুরি ও তালপাটি থানা এলাকা থেকে দু’জন মহিলা-সহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ১৫০ লিটার মদ।’’ জেলা পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়াও বলেন, ‘‘খেজুরি-সহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে ১৫ জন চোলাই মদ বিক্রেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রায় ৬৫০ লিটার চোলাই মদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে।’’


বাজেয়াপ্ত হওয়া চোলাই মদ। — নিজস্ব চিত্র।

খেজুরির বাসিন্দাদের অভিযোগ, স্থানীয় বাসিন্দা শেখ আসেকউদদ্দিন, শেখ সুফিয়ান বিভিন্ন এলাকা থেকে চোলাই নিয়ে এসে ওই গ্রামের ঠেকগুলিতে সরবরাহ করত। গ্রামে নয় নয় করে ১২টি ঠেক রমরমিয়ে চলত বলে অভিযোগ। যদিও মঙ্গলবার থেকে স্থানীয়রা অসুস্থ হতে শুরু করতেই ঠেক ছেড়ে পালায় চোলাই ব্যবসায়ীরা। বঙ্কিমবাবু ছাড়া বাকি মৃতদের নাম গৌতম প্রামাণিক (৩৮), নিমাই ভূঁইয়া (৫৬), অশোক মণ্ডল (৩২), রঞ্জিত মণ্ডল (৫৭), রবি জানা (৩৬)। শনিবার সকালে তমলুকে জেলা হাসপাতালে রবির মৃত্যু হয়। রঞ্জিত ছাড়া বাকি সকলেরই বাড়ি খেজুরি গ্রামে। রঞ্জিত জনকা পঞ্চায়েতের অরকবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা। রবির স্ত্রী রাধারানি জানা খেজুরি পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য। ছেলের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন রবির বাবা সুধাংশু জানা। তিনি বলেন, ‘‘সবসময় অন্যের উপকার করত ছেলে। যদিও মদ খাওয়ার অভ্যাস ছাড়তে পারেনি। তবে ছেলের এমন পরিণতির কথা স্বপ্নেও পারেনি।’’

খেজুরি-২ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অসীম মণ্ডলেরও অভিযোগ, ‘‘খেজুরি গ্রাম পঞ্চায়েতের বিভিন্ন এলাকায় গোপনে মদের ব্যবসা চলছে। লাইসেন্স ছাড়াই ঠেকে চোলাই থেকে বিলিতি সব মদই বিক্রি হচ্ছে।’’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও এ দিন মেদিনীপুরে বলেন, ‘‘বিষমদে আগেও বহু মৃত্যু হয়েছে। আমরা মগরাহাটের ঘটনা দেখেছি। এর দায়িত্ব পুরোপুরি সরকারের ও পুলিশের। কিন্তু সরকার তো টাকা দিয়ে দেবে। ফলে ঝামেলা শেষ। সমাধান না করে এ ভাবেই সমস্যা চাপা দেওয়া হচ্ছে।’’

জেলা হাসপাতালে ভর্তি খেজুরির অলিচক গ্রামের বাসিন্দা দেবেন আড়ি বলেন, ‘‘গত বুধবার বটতলা বাজারে বঙ্কিম দাসের চোলাই মদের ঠেকে মদ খেয়েছিলাম।’’ তাঁরা আরও বলেন, ‘‘ওই দিন সন্ধ্যাতেই বঙ্কিম মদ খেয়ে মারা যায়। আমরাও অসুস্থ হয়ে পড়ি। কিন্তু অবস্থা খারাপ হতে থাকায় শুক্রবার জনকা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যাই। সেখান থেকে জেলা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।’’

তমলুক জেলা হাসপাতালের সুপার গোপাল দাস বলেন, ‘‘খেজুরির জনকা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে আসা ওই রোগীরা চার দিন আগে মদ খেয়েছিলেন বলে জানানো হয়েছে। অসুস্থদের প্রত্যেকের বমিভাব, ঝাপসা দৃষ্টির লক্ষণ রয়েছে। বিষাক্ত মদ্যপানের ক্ষেত্রে এই ধরনের অসুস্থতা দেখা দেয়। এ ক্ষেত্রে তাঁদের অসুস্থতার কারণ খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

স্থানীয় বাসিন্দা জাহানারা বিবি, অনীতা পাত্রদের অভিযোগ, ‘‘বাড়ির ছেলেদের চোলাই ঠেকে যাওয়া নিয়ে প্রায়ই অশান্তি হত। গ্রামে দীর্ঘদিন ধরেই চোলাইয়ের ঠেক চলছে। পুলিশ, আবগারি দফতর নামমাত্র তল্লাশি চালায়। কিন্তু ঠেক বন্ধ হয় না।’’ শনিবার সকালে খেজুরি পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধান রেহানা খাতুনের নেতৃত্বে স্থানীয় মহিলারা চোলাই ঠেকগুলিতে ভাঙচুর চালায়। কয়েকটি ঠেকে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। পঞ্চায়েত প্রধান রেহানা বেগমের দাবি, ‘‘গ্রামে চোলাই বন্ধ করা নিয়ে বহুবার অভিযান চালানো হয়েছে। যদিও সাধারণ মানুষ সচেতন না হওয়ায় চোলাই বিক্রি বন্ধ করা হয়নি। এ বার ব্লক জুড়ে মদ বিরোধী অভিযান চালানো হবে।’’

এ নিয়ে জেলা আবগারি সুপার স্বপন হাজরা বলেন, ‘‘খেজুরি এলাকায় যারা অসুস্থ হয়েছেন, তাঁরা চোলাই মদ খেয়েই অসুস্থ হয়েছে কি না তা স্পষ্ট নয়। শনিবার সকালে জেলা হাসপাতালে যার মৃত্যু হয়েছে, তাঁর দেহ ময়না-তদন্ত করা হচ্ছে।’’ স্বপনবাবুর দাবি, ‘‘গত ছ’মাসে জেলার প্রায় ৮০ শতাংশ চোলাই মদের ব্যবসা বন্ধ করা গিয়েছে। যে সব এলাকায় এখনও বাকি রয়েছে সেখানে অভিযান চালানো হচ্ছে।’’

liquor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy