Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

আর শোনা যায় না তাঁত বোনার শব্দ

একটা সময় ছিল যখন গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়ি থেকে ভেসে আসত তাঁতের শব্দ। ধীরে ধীরে সেই আওয়াজ কমছিল। আর এখন, তাঁতকলের তেমন কোনও চিহ্নই মেলে না। পটাশপুরের বর্তমান ছবিটা এমনই। পটাশপুরের প্রাচীন নামের মধ্যেই ছিল এই পোশাকের আভাস।

শাড়ির বদলে এখন গামছাই বোনা হয় পটাশপুরে (বাঁ দিকে)। বাড়ির উঠোনে পড়ে রয়েছে ভাঙা তাঁত ( ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

শাড়ির বদলে এখন গামছাই বোনা হয় পটাশপুরে (বাঁ দিকে)। বাড়ির উঠোনে পড়ে রয়েছে ভাঙা তাঁত ( ডান দিকে)। —নিজস্ব চিত্র।

কৌশিক মিশ্র
পটাশপুর শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০১৫ ০০:১৮
Share: Save:

একটা সময় ছিল যখন গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়ি থেকে ভেসে আসত তাঁতের শব্দ। ধীরে ধীরে সেই আওয়াজ কমছিল। আর এখন, তাঁতকলের তেমন কোনও চিহ্নই মেলে না। পটাশপুরের বর্তমান ছবিটা এমনই।

পটাশপুরের প্রাচীন নামের মধ্যেই ছিল এই পোশাকের আভাস। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় ‘‘পট্টবাস’’ থেকে প্রথমে পট্টবাসপুর পরে তা পরিবর্তিত হয়ে এলাকাটির নাম হয় পটাশপুর। ইতিহাস বলছে, অবিভক্ত মেদিনীপুরের অর্থনীতিতে কৃষির পরেই ছিল গ্রামীণ তাঁতশিল্পের স্থান। এই জেলার গ্রামবাসীদের আর্থিক স্বাচ্ছ্যন্দের অনেকটাই নির্ভর করত তাঁত শিল্পের উপর। প্রায় প্রতিটি গ্রামেই ছিল একটি করে তাঁতিপাড়া। গ্রামবাসীর মোটা কাপড়ের চাহিদা মেটাতো এই কাপড়ই। তবে শুধু মোটা কাপড় নয়, এক সময় পটাশপুর এলাকায় তৈরি অমর্ষির শাড়ি ছিল এলাকার বিখ্যাত সম্পদ। রাজ্যে সেই কাপড় বিখ্যাত ছিল অমর্ষি-তাঁত নামে। তার সঙ্গে তুলনা করা হত শান্তিপুরের তাঁতের। ‘‘পটাশপুরের কথা’’ বই বলছে, ‘‘পূর্বে এই থানায় ব্যাপক রেশম শিল্পের ব্যবস্থা ছিল। অল্প কয়েক বছর পূর্বে উহা লুপ্ত হইয়াছে। এখন পটাশপুরের খড়ুইতে কিছু কিছু তসর তৈয়ারি করা হয়।’’ আগে পটাশপুরে যে রেশম শিল্প ছিল তার প্রমাণ মেলে ইংরেজ ঐতিহাসিক বেলি সাহেবের ‘মেমোরান্ডা অফ মিদনাপুর’ বইতেও।

পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯৬ সালে কাটনাদিঘিতে রয়েছে ৭৪ টি তাঁতকল। পটাশপুরের অমর্ষি-র শাড়ি, সরিদাসপুরের ধুতি, প্রতাপদিঘি-র মোটা সুতির গামছা ছিল বিখ্যাত তাঁত শিল্পের নিদর্শন। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকার ছবিটা গিয়েছে বদলে। হারিয়ে গিয়েছে আগেই সেই ঐতিহ্যও। তাঁত কলের সেই আওয়াজ আজ আর শোনা যায় না। একদিকে যেমন রয়েছে আধুনিক যন্ত্র নির্ভর সভ্যতায় তাঁতের গুরুত্ব হ্রাস। তেমনই রয়েছে অল্প পয়সার মুনাফায় তাঁতের প্রতি এলাকার মানুষের অনাগ্রহ। এছাড়া হাল ফ্যাশনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরেও কোথাও পিছিয়ে পড়ছে তাঁতের চাহিদা। এছাড়া প্রচারের অভাব নিয়ে অভিযোগ তো রয়েছেই।

এলাকার প্রবীণ তাঁত শিল্পী রমেশ জানার কথায়, ‘‘আগে এখানে তৈরি তাঁতবস্ত্র ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যেত। ধীরে ধীরে সেই পরিমাণ অনেক কমে আসে। তাঁত শিল্পীরাও মুনাফার মুখ না দেখতে পেয়ে একে একে বন্ধ করে দিতে থাকেন তাঁতকলগুলি।’’ এলাকায় গিয়ে দেখা যায় পুরানো তাঁতের কলগুলি ভেঙে পড়ে রয়েছে বাড়ির উঠোনে। বিক্ষিপ্তভাবে তৈরি হয় শাড়ি আর গামছা। পটাশপুরের কাছে অমর্ষি,সা মখোলা,পূ র্ব অমর্ষি, বাসুদেবপুর, ব্রজলালপুর, বারোভাগিয়া, সরিদাসপুর-সহ আরও গোটা কুড়ি গ্রামই এখন প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে তাঁতশিল্পের মানচিত্র থেকে। অমর্ষি-র প্রবীণ তাঁত শিল্পী প্রদীপ মাইতির কথায়, ‘‘এখন কত উন্নত প্রযুক্তি এসে গিয়েছে। তার সঙ্গে আমরা তাল মেলাতে পারছি না তাই ছিটকে যেতে হচ্ছে প্রতিযোগিতা থেকে। মাঝে কিছু সরকারী উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। তবে এখন আর কোন হেলদোল নেই। তাই হারিয়ে যেতে বসেছে পটাশপুরের বিখ্যাত তাঁত শিল্পের ঐতিহ্য।’’

যদিও পটাশপুরে এখনও রয়েছে বেশ কিছু তন্তুবায় সমবায় সমিতি। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সরিদাসপুর তন্তুবায় সমিতি। এখানে আগে ছিল ৩৮২ জন তাঁত শিল্পী আর ছিল প্রায় ২৫০ টি তাঁতকল। বর্তমানে কমে তা চলে এসেছে দুই সংখ্যার অঙ্কে। এছাড়া অমর্ষি তন্তুবায়, বাগমারি, চন্দনপুর, পটাশপুর বাজার এলাকার তন্তুবায় সমিতিগুলিতে বর্তমানে সদস্য ও তাঁতকলের সংখ্যা দিনের পর দিন কমেই চলেছে বলে জানান সমবায়গুলির আধিকারিকেরা। তবে আশার কথা এই যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পশ্চিমবঙ্গ হ্যান্ডলুম সমবায় সমিতি এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকার তাঁত শিল্পীদের জন্য ঋণদান, ব্যাঙ্ক ঋণের সরলীকরণের মাধ্যমে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। চলছে উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও।

আগামী দিনে কি বদলাবে পটাশপুরের তাঁতশিল্পের ছবিটা? উত্তর দেবে ভবিষ্যৎই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE