Advertisement
০৪ মে ২০২৪
ধান-আলুর ক্ষতি ঠেকাতে জোর বিকল্প চাষে

খেতের আলে অড়হর, চাষ বাড়ছে বর্ষাকালীন পেঁয়াজে

শুধু আলু বা ধানের উপর নির্ভর করে চাষিদের হামেশাই ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এখন তাই জোর দেওয়া হচ্ছে বিকল্প চাষে। আপাতত, তিন ধরনের বিকল্প চাষে উৎসাহ বাড়াতে তৎপর হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন। বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষের এলা ও বাদাম চাষের এলাকা বাড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে ধানের সঙ্গে পরীক্ষা-মূলক ভাবে জমির আলে অড়হর ডাল চাষ করা হচ্ছে। শিবির করে অন্য তৈলবীজ ও ডালশস্য চাষেও চাষিদের উত্‌সাহিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

শালবনিতে সরিষা চাষ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

শালবনিতে সরিষা চাষ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৮ জুন ২০১৫ ০০:১৩
Share: Save:

শুধু আলু বা ধানের উপর নির্ভর করে চাষিদের হামেশাই ক্ষতির মুখে পড়তে হয়। এখন তাই জোর দেওয়া হচ্ছে বিকল্প চাষে। আপাতত, তিন ধরনের বিকল্প চাষে উৎসাহ বাড়াতে তৎপর হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা প্রশাসন। বর্ষাকালীন পেঁয়াজ চাষের এলাকা ও বাদাম চাষের এলাকা বাড়ানো হচ্ছে। সেই সঙ্গে ধানের সঙ্গে পরীক্ষা-মূলক ভাবে জমির আলে অড়হর ডাল চাষ করা হচ্ছে। শিবির করে অন্য তৈলবীজ ও ডালশস্য চাষেও চাষিদের উত্‌সাহিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি এ নিয়ে বৈঠকও করেছে প্রশাসন। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পরিষদের কৃষি কর্মাধ্যক্ষ নির্মল ঘোষ বলেন, “বিকল্প চাষ না বাড়ানো পর্যন্ত চাষিদের আয় সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই আলু ও ধান চাষের থেকে চাষিদের নজর ফেরানোর দিকে জোর দেওয়া হচ্ছে।” কৃষি দফতরের ডেপুটি ডিরেক্টর নিমাইচাঁদ রায়েরও বক্তব্য, “ধান চাষের সঙ্গে সঙ্গে আলে অড়হর ডাল চাষ, বাদামের এলাকা বৃদ্ধি, বর্ষাকালীন পেঁয়াজ সহ বিভিন্ন চাষের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে চাষিদের বুঝিয়ে বিকল্প চাষে তাঁদের ঝোঁক তৈরি করা যায়।”

গত মরসুমে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় তৈল বীজ, ডাল শস্য, আখ-সহ ১২ ধরনের চাষ হয়েছিল। চাষের এলাকা ছিল ৪১,০৯২ হেক্টর। সেখানে জেলায় আলু চাষ হয়েছিল ৮৩,০৩১ হেক্টর জমিতে! অর্থাত্‌ ১২ ধরনের চাষের তুলনায় দ্বিগুণ ছিল আলু চাষের এলাকা। অথচ, জেলার সর্বত্র আলু চাষ হয় এমন নয়। মেদিনীপুর সদর মহকুমার একাংশ ও ঘাটালে আলু চাষের মাত্রা বেশি। চলতি বছরে জেলায় আলুর ফলনও হয়েছে ২৮ লক্ষ টন। অথচ জেলার ৭১টি হিমঘরে আলু সংরক্ষণ করা যায় ১৬ লক্ষ টন। অর্থাত্‌ ১২ লক্ষ টন সংরক্ষণেরও জায়গা নেই। এ দিকে, আলু বেশি দিন বাইরে ফেলে রাখলে তা পচে যায়। ফলে কম দামে আলু বিক্রিতে বাধ্য হয়েছেন কৃষকেরা। আলুর পরিমাণ কিছুটা কমিয়ে সেই জমিতে সরিষা, গম-সহ অন্য চাষ করলে চাষিদের ক্ষতির বহর কমত।

বিকল্প চাষে আগ্রহ বাড়াতে কৃষি দফতর নানা কর্মসূচি করে থাকে। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয় না। কিন্তু কেন? কৃষি দফতরের আধিকারিকদের মতে, আলু চাষে এক মরসুমে ক্ষতি হলেও পরের মরসুমের লাভে তা পুষিয়ে যায়। কিন্তু সরিষা বা গমে অত লাভ পাওয়া যায় না। তাই ঝুঁকি নিয়েও চাষিরা আলু চাষই করেন। চন্দ্রকোনার আলু চাষি রবীন্দ্রনাথ পাত্রের কথায়, ‘‘আলু বেচেই তো বাড়ি বানিয়েছি, গাড়িও কিনতে পেরেছি। আগে শুধু ধান, সরিষারই চাষ হত। কিন্তু কোনও চাষ এত লাভ দিতে পারেনি। যে বছর বেশি ক্ষতি হয় সে বছর আফসোস হয়। মনে হয়, আলু চাষ কমিয়ে অন্য কিছু করলে হত। কিন্তু আবার শীত পড়লেই আলু চাষে নেমে পড়ি।’’

বিকল্প চাষ করে সুফল পাচ্ছেন, এমন চাষি আছেন। যেমন, গড়বেতার চাষি হারাধন মণ্ডলের কথায়, ‘‘আগে পুরো জমিতেই আলু চাষ করতাম। কিন্তু কয়েক বার ক্ষতি হওয়ায় এখন কিছুটা সরিষা করি। এতে সুবিধাই হয়েছে।’’ আর এক চাষি সুব্রত পাল বলেন, ‘‘আগে আলুর জমির চারদিকে সরিষা লাগানো হত। জমির মাঝের নালার দু’দিকের উঁচু অংশেও সরিষা লাগানো হত। পরে বেশি লাভের আশায় সেখানে আলু লাগাতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু আলুতে ক্ষতির পর এখন কিছুটা গম চাষ করি।’’

এই ধরনের চাষির সংখ্যা কিন্তু হাতেগোনা। বেশিরভাগ চাষি এখনও আলু আর ধানের উপরই নির্ভরশীল। চলতি বছরেও আলুতে ক্ষতি হয়েছে। কাঁচা আলুর দাম না মেলায় চাষিরা অনেকে হিমঘরে সংরক্ষণ করেছেন। পরেও যদি আলুর দাম না বাড়ে ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতি ঠেকাতেই কৃষি দফতর বিকল্প চাষে জোর দিচ্ছে। চলতি বছরে বর্ষাকীন পেঁয়াজ চাষের এলাকা বাড়ানো হচ্ছে। গত বছর যেখানে ২০০ কেজি পেঁয়াজ বীজ বিলি করা হয়েছিল, সেখানে এ বার দেওয়া হচ্ছে ৬০০ কেজি। ৮০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ ফলানো যাবে।

কৃষি দফতর এ বার ৬২ জায়গায় পরীক্ষামূলক ভাবে বর্ষাকালীন ধান চাষও করবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ১০০ হেক্টর জমিতে চাষিদের দিয়ে ধান ফলানো হবে। আর জমির আলে চাষ হবে অড়হর ডাল। সরকারের কাছ থেকে বাদাম বীজ পাওয়ার আশ্বাসও মিলেছে। আলুর পাশাপাশি চাষিরা যাতে অন্তত কিছুটা জমিতে মটরশুঁটি, সরিষা, গম, ভুট্টা, সূর্যমুখী চাষ করেন সে বিষয়েও কৃষি আধিকারিকেরা পরামর্শ দেবেন। একই সঙ্গে কৃষি দফতরের এক আধিকারিক মানছেন, ‘‘আলুর মতো অর্থকরী ফসল থেকে চাষির দৃষ্টি ফেরানো যে সহজ নয়, তা আমরা জানি। তবু সরকার বিকল্প চাষে বীজ দিয়ে সহযোগিতা করলে সাফল্য মিলবে বলে আমাদের আশা।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE