নাটকের কর্মশালায়। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
ক্লাস ফোরের ছোট্ট দিলশান সব সময়ই অন্যমনস্ক। পড়ায় মন নেই। খেলাতেও না। নিজের হাতে খেতেও চায় না। অপরিচিত জনের সামনে একেবারে জড়োসড়ো। ছেলেটি সব সময় যেন কল্পনার রাজ্যে বাস করে। পরীক্ষায় লিখে এসেছিল পৃথিবীর সব থেকে বড় প্রাণীর নাম বুনিপ!সেই দিলশানের লজ্জা ভাঙা হল নাটকের কর্মশালায়। শুধু দশ বছরের দিলশানই নয়, শিলদার বাসিন্দা প্রাথমিক স্কুলশিক্ষক হর্ষনারায়ণ মণ্ডল, বেলপাহাড়ির সঙ্গীতশিল্পী অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়, বেলিয়াবেড়ার কলেজ পড়ুয়া তমাল দে, ঝাড়গ্রামের ছাপাখানা ব্যবসায়ী শ্যামল পাল, বিমা কর্মী তাপস নন্দীরা কেউ হলেন টিকটিকি, কেউ আবার কুকুর। কেউ ছাগল কেউ আবার বিড়াল। চারাপাশের সব সময়ে আমরা যা দেখে থাকি, সেই বিষয়গুলিকে তাৎক্ষণিক অভিব্যক্তি দিয়ে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমেই ভাঙা হল বাধার শিকল। শনিবার দিনভর কর্মশালার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘এসে লজ্জা ভাঙি: সবার জন্য নাটক’।
ঝাড়গ্রামের ‘এসো নাটক করি’ এবং ‘কুরকুট’ সংস্থার যৌথ উদ্যোগে ঝাড়গ্রাম শহরের বলাকা হলে এক দিনের এই কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছিল। উদ্যোক্তাদের তরফে অভিষেক বর্মণ ও উপল পাহাড়ি শুরুতেই জানিয়েছিলেন, নাটকের মাধ্যমে জীবনের নানা সমস্যা থেকেও যে উপশম মেলে, বাস্তবে সেটা পরখ করে দেখানোর জন্য এই কর্মশালার আয়োজন।
কোনও প্রবেশ মূল্য ছাড়াই জঙ্গলমহলের বিভিন্ন পেশার বিভিন্ন বয়সের ২০ জন কর্মশালায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ভাল অভিনয়ের জন্য আগামীর অভিনেতা হিসেবে কেউ কেউ নজর কাড়লেন। প্রশিক্ষক হিসেবে এসেছিলেন কলকাতার ‘অল্টারনেটিভ লিভিং থিয়েটর’-এর কর্ণধার তথা বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব প্রবীর গুহ। তিনি জানালেন, ব্যক্তিত্ব বিকাশের অন্যতম সহজ মাধ্যম হল নাটক। দলগত যোগদানের মাধ্যমে সৃষ্টির অবকাশ যেমন রয়েছে, তেমনই নিজের সৃষ্টিকে ভেঙে চুরে নতুন থেকে নতুনতর কিছু করে দেখানোর সুযোগ রয়েছে। বর্তমান গতির যুগে নাটক দিয়ে মনখারাপের রিলিফ মিলতে পারে।
‘তারে জমিন পে’-র দিলসানের সমস্যার দাওয়াইও বাতলে দিলেন প্রবীরবাবু। এক জন গাছের মতো স্থানুবৎ দাঁড়ালেন। দিলশানকে বলা হল, মানুষ-গাছের কাঁধে চড়তে হবে। অনেক কসরত করেও দিলসান গাছ-মানুষের কাঁধে চড়তে পারল না বটে। তবে চেষ্টার জন্য হাততালির বাহবা পেল সে। দুপুরে লাঞ্চ ব্রেক। অন্য স্কুলের অপরিচিত দুই দাদা পঞ্চম শ্রেণির সুস্নাত ঘোষ ও অষ্টম শ্রেণির ঋতভ ঘোষের পাশে বসে রুটি আর ডিমের কষা খেল নিজের হাতে। পাত পরিষ্কারও করল নিজে।
দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হল ‘রমেশ পাল আর মাটির তাল’ খেলা। এক দল রূপক মাটির তাল। অন্যদল মৃৎশিল্পী। জ্যান্ত মানুষগুলোকে বিভিন্ন অভিব্যক্তি দিয়ে মূর্তি সাজিয়ে সেরা মূর্তি বিচার করলেন নিজেরাই। রূপক সংলাপে কালীয় নাগের ছানাপোনারা ফোঁস ফোঁস করে বলল, “নির্বাচনে জিতলে দু’টাকা কিলো চাল দেব। শিল্প করব। বহুত সারে শ্রী-শ্রী দেঙ্গে।” নাগেদের মাথায় কৃষ্ণরূপী অতনু বললেন, “আমি নির্বাচন কমিশন, সমঝে বলো। তোমাদের মাথার উপর কিন্তু কড়া নজর রাখছি।” হাততালি দিয়ে প্রবীরবাবু বললেন, “এই সৃজনশীল ভাবনাই কর্মশালার সেরা পাওনা।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy