এমপিএসের আইল্যান্ড রিসর্ট ছিল এমন (বাঁ দিকে), রিসর্টের ঘর এখন যেমন (ডান দিকে) ছবি:দেবরাজ ঘোষ।
রিসর্টের এক একটি ঘরের দৈনিক সর্বোচ্চ ভাড়া ছিল বারো থেকে চোদ্দ হাজার টাকা। সঙ্গে ছিল সুইমিং পুল, মাল্টিজিম, হার্বাল ম্যাসাজ থেরাপি সেন্টার। চারিদিকে ঘন সবুজ গাছগাছালি। জলের উপর ঝুলন্ত কংক্রিটের সেতু পেরিয়ে দেখা মিলত এক আশ্চর্য জগতের! চোখ ধাঁধানো সেই বিলাসবহুল ‘আইল্যান্ড’ রিসর্টগুলির সঙ্গে তুলনা টানা হত সাত তারা মানের হোটেলের সঙ্গে।
ঝাড়গ্রামের উপকন্ঠে দহিজুড়ির দিঘিশোলে বেআইনি অর্থলগ্নি সংস্থা এমপিএসের এই বিলাসবহুল রিসর্টগুলিতে চালু ছিল মেম্বারশিপ। মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে সদস্য হওয়া যেত। সেই টাকা সংস্থার ব্যবসায় লগ্নি করা হত। ঝাঁ-চকচকে রিসর্টের ঘরগুলিতে অফ সিজনে বিনা ভাড়ায় তিনদিন থাকার সুযোগ পেতেন সদস্যরা। আর পর্যটনের মরসুমে এই সব রিসোর্টে সারা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্চবিত্ত লোকজন ও বিদেশি পর্যটকরা বুকিং করে
বেড়াতে আসতেন।
শুধু তাই কেন, সুসজ্জিত আরামদায়ক গরুর গাড়িতে অথবা দূষণহীন যানে ৬০০ একর খামারটির নির্বাচিত কিছু এলাকা ঘুরিয়ে দেখানো হত পর্যটকদের। ওই আইল্যান্ডের কাছেই রয়েছে আরও একাধিক বিলাসবহুল থাকার ঘর-সহ একটি ওয়াচ টাওয়ার। সেখান থেকে খামারের নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখার মতো। আইল্যান্ডের এলাকায় পর্যটকদের জন্য রোপওয়ে তৈরি হয়েছিল। তবে রোপওয়ে চালু হওয়ার আগেই তালা পড়ে যায় এমপিএসের দিঘিশোলের রেজিস্টার্ড অফিসে। এখন পুরো চত্বরটা ইতিহাসের খণ্ডহর।
বুধবার হাইকোর্ট নিযুক্ত কমিটির সদস্যরা পরিদর্শনে এসে দেখেন গোটা আইল্যান্ড রিসর্ট চত্বরটি ভূতুড়ে বাংলোর মতো। রিসর্টের প্রতিটি ঘরের দরজা ভেঙে এসি মেসিন, ফ্রিজ, ওয়াল টিভি, খাট, সোফা, দামি আসবাপত্র উধাও হয়ে গিয়েছে। সব কিছু তছনছ করে দেওয়া হয়েছে। রিসেপশনের দামি কাঁচের দরজার কাচ ভেঙে গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বিলাসবহুল ক্যাফেটোরিয়ার একই দশা। খামারের অন্যান্য বিভাগগুলির মতো গোটা আইল্যান্ড রিসর্টটিও কার্যত কঙ্কালে পরিণত হয়েছে। সব দেখেশুনে কমিটির সদস্যরা কিছুটা হতভম্ব।
গত বছর কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে কেবলমাত্র সংস্থার রেজিস্টার্ড অফিসটি সিল করে দিয়ে পুলিশ প্রহরা বসানো হয়েছিল। অফিস সংলগ্ন একটি ভবনে অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প হয়েছে। কিন্তু এমপিএসের সহযোগী সংস্থাগুলি সিল করা হয়নি। মূল অফিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এমপিএসের সহযোগী সংস্থাগুলির বিভিন্ন বিভাগে উৎপাদন ও রিসর্ট ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়। সংস্থার পক্ষ থেকে ওই সব বিভিন্ন বিভাগ ও ভবনগুলিতে তালা ঝোলানো হয়। পুরোপুরি খামারটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মহীন হয়ে পড়েন কয়েক হাজার মানুষ। যাঁদের বেশির ভাগই আদিবাসী-মূলবাসী।
এমপিএস মামলাটি দেখছেন প্রধান বিচারপতি মঞ্জুলা চেল্লুরের ডিভিশন বেঞ্চ। সংস্থার মালিক প্রমথনাথ মান্না এখন জেলবন্দি। আমানতকারীদের টাকা ফেরাতে বিশেষ কমিটি গড়ে দিয়েছে হাইকোর্ট। এখন এমপিএসের এই খামারটির যাবতীয় দায়িত্ব হাইকোর্ট নিযুক্ত বিশেষ কমিটির হাতে রয়েছে। কমিটির চেয়ারম্যান হলেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শৈলেন্দ্রপ্রসাদ তালুকদার। কমিটির চেয়ারম্যানের নির্দেশক্রমে এমপিএসের সম্পত্তির তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করতে এসেছেন অর্থ দফতরের আধিকারিক প্রবীরকুমার ঘটকের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। কিন্তু পরিদর্শনের তৃতীয় দিনেও বুধবার কেবল ধ্বংসের ছবি দেখতে হয়েছে কমিটির সদস্যদের। এ দিন সংস্থার রাইস প্রোসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং ডিভিশন-এ শাটার খুলে দেখা যায় ভিতরের জানলা ভাঙা। বহুমূল্য যন্ত্রাশের মোটর চুরি গিয়েছে। এ দিন রিসর্টের লাগোয়া জিম, সুইমিং পুলও ঘরে দেখেন প্রতিনিধিরা।
আমানতকারীদের আইনজীবী শুভাশিস চক্রবর্তী বলেন, “যেভাবে লুঠপাট চলছে, তাতে দ্রুত সম্ভব পদক্ষেপ করা না হলে আমানতকারীদের টাকা পাওয়ার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। আমরা বিষয়টি হাইকোর্টের নজরে আনব।” শুভাশিসবাবুর দাবি, “পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, একটি দুষ্টচক্র পরিকল্পিতভাবে নিয়মিত লুঠপাঠ চালাচ্ছে। খোলা বাজারে কারা এসব জিনিসপত্র কিনছে, পুলিশ তদন্ত করে দেখুক।”
এমপিএসের আইনজীবী গৌরব দাস ও কৌশিক চৌধুরী এ দিন বলেন, “আদালতের নির্দেশে এক বছর আগে সম্পত্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। এক বছর পরে আমরা পর্যালোচনা করে সেই সব সম্পত্তির যে গরমিল পেয়েছি তার বিস্তারিত রিপোর্ট পরবর্তী শুনানির দিনে (৯ জুন) হাইকোর্ট নিযুক্ত কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে জমা দেব। সংস্থার সম্পত্তির নিরাপত্তা বিধানের জন্য কমিটির কাছে আমরা আবেদন জানাব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy