ভাঙন ঠেকাতে শিলাবতীর নদীবাঁধে ফেলা হয়েছে বালির বস্তা।— নিজস্ব চিত্র।
জলস্তর ক্রমশ বাড়ছে। ঘাটালে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে প্রশাসন। আতঙ্কিত মহকুমার বাসিন্দারাও।
সোমবারও ঘাটালের সমস্ত নদীর জলস্তর ছিল চরম বিপদ সীমার উপর। যে কোনও সময় নদীর বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। দুর্বল বাঁধ গুলিতে বালির বস্তা দিয়ে মেরামতির কাজ চললেও জলের দুরন্ত গতিতে বালির বস্তাও ভেসে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ফলে আতঙ্কিত ঘাটাল পুরসভার পাঁচটি ওয়ার্ড-সহ ৮৬টি মৌজার বাসিন্দারা।
নদীবাঁধ ভেঙে প্লাবনের অভিজ্ঞতা অবশ্য এ সব অঞ্চলে নতুন কিছু নয়। শেষ বার বন্যা হয়েছিল ২০০৭ সালে। স্থানীয়দের অভিযোগ, তখন ঘাটাল পরিদর্শনে এসে নদী বাঁধ গুলিকে মজবুত করার নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। বাঁধের উপর দিয়ে ভারী যান চলাচল বন্ধ করা বা সেচ দফতরের জমি ঘিরে বাড়ি তৈরি বন্ধের নির্দেশও ছিল। কিন্তু বাস্তবে কোনও কাজই হয়নি।
সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন ফোনে বলেন, “ঘাটালের শিলাবতী ও কংসাবতী নদীর একাধিক বাঁধের অবস্থা খুবই খারাপ। দফতরের লোকজন মেরামতির কাজে যুক্ত রয়েছেন। তবে আশঙ্কা থাকলেও নতুন করে বৃষ্টি না হলে কোনও সমস্যা হবে না।” এ দিকে ঘাটালের মহকুমা সেচ আধিকারিক উত্তম হাজরা বলেন, “নদীর জল বেড়েই চলছে। তাতেই ঘাটালের একাধিক নদী বাঁধের অবস্থা খারাপ। এখনও পর্যন্ত বালির বস্তা দিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে।”
ক’দিন ধরেই ঘাটালের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর ছড়িয়েছে। বাঁধ ভাঙলে ঘাটাল শহরের মহকুমাশাসকের দফতর থেকে মহকুমা হাসপাতাল, নার্সিংহোম-সহ মহকুমা স্তরের সমস্ত সরকারি অফিস জলের তলায় চলে যাবে। এ সব এলাকা সাধারণত অল্প বর্ষায় বানভাসী হয় না। ফলে বন্যায় অভ্যস্ত না হওয়ায় সমস্যার শেষ থাকবে না বলে আশঙ্কা। স্বস্তিতে নেই প্রশাসনের আধিকারিক থেকে শাসকদলের প্রতিনিধিরাও।
শনিবার বিকাল থেকে বাঁধের অবস্থা দেখে আতঙ্ক আরও ছড়িয়েছে। কখনও বাঁধ ভেঙে গিয়েছে বলে গুজব ছড়িয়ে পড়ছে মুহূর্তের মধ্যে। ফলে বাজার থেকে ভুষিমালের সরঞ্জাম কিনে আগে-ভাগে সব নিজেদের প্রস্তুতও করতে শুরু করেছেন নদী পাড়ের বাসিন্দারা।
আর এই ভীতি দেখেই শুরু হয়েছে কালোবাজারি। আলু, চাল থেকে ভুষিমালের আকালও দেখা দিয়েছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এই সুযোগে সব জিনিসের দাম একলপ্তে সব দ্বিগুণে বিক্রি শুরু করেছেন। কেননা, বাঁধ ভেঙে বন্যা হলে তা অন্তত দশ দিনের বেশি জল জমে থাকবে। তাই সবাই সাধ্য মতো জিনিস কিনে মজুত রাখতে শুরু করে দিয়েছেন।
রবিবার থেকে প্রতি কিলো আলুর ১০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫-২০ টাকা। চালের দামও আকাশছোঁয়া। বিভিন্ন প্রকারের চাল প্রতি কিলোতে আট থেকে দশ টাকা বেড়ে গিয়েছে। আর শাকসব্জির নির্দিষ্ট কোনও দর নেই। পেঁয়াজ ৬০ টাকা। এমনিতেই সব্জি বাজারে নেই বললেই চলে। যা আসছে-তা সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। একই অবস্থা ভুষিমাল দোকানেও। সয়াবিন, তেল, ডাল, ডিম সবেরই দমা চড়া। সোমবারেও একই পরিস্থিতি।
এ দিকে মহকুমা প্রশাসন সূত্রের খবর, ঘাটাল ব্লকের ১০টি সহ মহকুমার চন্দ্রকোনা-১ ও ২ এবং দাসপুর-১ ব্লকের একাধিক পঞ্চয়েত জলের তলায়। জল বেড়ে চলায় প্রায় বেশিরভাগই সংলগ্ন নদী বাঁধে, ত্রাণ শিবিরে বা পড়শির উঁচু বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। অভিযোগ, সরকারের তরফে ‘কোনও সমস্যা নেই’ বলে প্রচার করা হলেও ত্রাণের যে হাহাকার চলছে-তা কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় গেলেই বোঝা যাচ্ছে।
ঘাটালের মনসুকা-২, সুলতানপুর, ইড়পালা, অজবনগর, দাসপুরের নাড়াজোল, চন্দ্রকোনার যদুপুর, মানিককুণ্ডু প্রভৃতি এলাকায় গেলে বন্যার সঠিক দুদর্শার ছবিটা স্পষ্ট হবে। সঙ্গে ত্রাণ নিয়ে রাজনীতির অভিযোগও উঠছে। বাসিন্দারা বলছেন, এলাকায় নৌকায় করে ত্রাণ নিয়ে এসে বেছে বেছে দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় শাসক দলের নেতৃত্বরা যা নির্দেশ দিচ্ছেন, তার বাইরে কেউই সরকারি ত্রাণ পাচ্ছে না বলে আভিযোগ।
আভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দোলই বলেন, “বিরোধী দল গুলি এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। এত দিন ঘাটালে বন্যা হচ্ছে, কোনও দিন ঘাটালের মানুষ মন্ত্রী দূরের কথা, এলাকার সাংসদ, বিধায়ককে কাছে পেয়েছেন? আমি প্রতিটি এলাকায় যাচ্ছি।’’ তাঁর দাবি সমস্ত মানুষকে উদ্ধার করে শিবিরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কোথাও ত্রাণ নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। শুধু জল বাড়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে বলেই যা কিছু অসুবিধা।
ঘাটালের মহকুমাশাসক রাজনবীর সিংহ কপূরও বলেন, “প্রতিটি গ্রামে নৌকা, ত্রাণ, পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। পরিস্থিতি সবই স্বাভাবিক।” জেলার সহকারি মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক দেবদুলাল মুখোপাধ্যায় বলেন, “ঘাটালে মোট ১৬টি স্বাস্থ্য শিবির খোলা হয়েছে। দুর্গত এলাকায় গিয়ে ওষুধ, হ্যালোজেন ট্যাবলেট বিলি করা হচ্ছে। মজুত রাখা হয়েছে সাপে কামড়ানো ওষুধও।”
এ দিন বিকেলে বৃষ্টির জমা জলে প্লাবিত দাসপুরের চাঁইপাটে আসেন পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়। দুর্গতদের হাতে ত্রাণ তুলে দেন।
ঘাটালের বন্যা পরিস্থিতি ঘুরে দেখেন সাংসদ দীপক অধিকারী। সোমবার নৌকায় করে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে রানির বাজারে নামেন তিনি। জনা ২০ দুর্গত মানুষকে সরকারি কিট বিলি করে বিকেল সওয়া ৪টে নাগাদ ঘাটাল মহকুমাশাসকের দফতরে সাংবাদিক বৈঠক করেন। বলেন, ‘‘প্রতিনিয়ত মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হচ্ছে। পর্যাপ্ত ত্রাণ, স্বাস্থ্য শিবির, নৌকা— সব কিছুর বিষয়েই আর্জি জানিয়েছি।’’ এর আগে দেব দাসপুর ১ও ২ ব্লকে প্রশাসনিক বৈঠক করেন। একটার নাগাদ ঘাটালের কৃষ্ণনগরে পৌঁছয় তাঁর কনভয়। দেবের আসার খবরে এই দুর্যোগের মধ্যেও ভিড় করেন মানুষ। দেবের সঙ্গে ছিলেন ঘাটালের বিধায়ক শঙ্কর দোলই, বিকাশ কর, দিলীপ মাঝি, মহকুমাশাসক রাজনবীর সিংহ কপূর।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy