এই রাধাকৃষ্ণণ হল থেকেই লোকেশের দেহ উদ্ধার হয়। —নিজস্ব চিত্র।
জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মানসিক চাপ, পরিবার থেকে দূরে থাকার অবসাদ নাকি অন্য কোনও কারণ। ১৩ দিনের মধ্যে খড়গপুর আইআইটির হোস্টেলে ফের এক ছাত্রের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধারের পর এই জল্পনাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
আইআইটি-র পড়ুয়াদের মানসিক চাপ কাটাতে ২০০৯ সালে চালু হয় কাউন্সেলিং সেন্টার। সেই সঙ্গে আইআইটি-র পড়ুয়াদের নিয়ে একটি ‘সুডেন্টস ওয়েলফেয়ার গ্রুপ’ও গঠন করা হয়। এই গ্রুপে প্রতিটি হল (হোস্টেল) থেকে তিন-চারজন পড়ুয়াকে কো-অর্ডিনেটরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। আইআইটি-র কোনও ছাত্রের মধ্যে কোনওরকম অস্বাভাবিকত্ব দেখা গেলেই তাঁকে কাউন্সেলিং সেন্টারে নিয়ে আসার দায়িত্ব দেওয়া হয় কো-অর্ডিনেটরদের উপর। পড়ুয়াদের একাংশের অভিযোগ, কাউন্সেলার ও কে-অর্ডিনেটরদের সংখ্যা কম থাকায় কাউন্সেলিং সেন্টার ঠিকমতো কাজ করছে না। ফলে পড়ুয়াদের সমস্যার কারণ সম্পর্কে কোনও কিছু বোঝার আগেই ঘটে যাচ্ছে দুর্ঘটনা। তবে আইআইটি কর্তৃপক্ষের দাবি, কাউন্সেলিং সেন্টারে আসার ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের আগ্রহের অভাব রয়েছে।
সোমবার আইআইটি-র রাধাকৃষ্ণণ হলে ঝুলন্ত অবস্থায় উদ্ধার হয় ডুয়াল ডিগ্রি কোর্সের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চতুর্থ বর্ষের পড়ুয়া লোকেশকুমার গোয়েলের (২২) দেহ। মায়ের উদ্দেশে লোকেশের লেখা একটি অসম্পূর্ণ সুইসাইড নোটও পুলিশ উদ্ধার করেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, তিন দিন আগেও লোকেশ আয়নার কাচ ভেঙে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। তবে তাঁর আত্মহত্যার কারণ সম্পর্কে ধোঁয়াশা এখনও রয়েই গিয়েছে। রাধাকৃষ্ণণ হলের ওয়ার্ডেন অধ্যাপক অরূপকুমার দাস বলেন, “ছেলেটি ভাল ছাত্র ছিল। তবে কি কারণে লোকেশ আত্মহত্যা করল তা বোঝা যাচ্ছে না। ওঁর পরিবারও এবিষয়ে কিছু জানাতে পারেনি।” কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপিকা স্বাতী নিয়োগী বলেন, “আমার কাছে লোকেশ এক বছর ধরে একটি প্রকল্পের কাজে রয়েছে। ওঁকে দেখে কখনও কিছু বুঝতে পারিনি।” প্রসঙ্গত, গত ১৭ মার্চ আইআইটি-র মদনমোহন মালব্য হলে বোগা শ্রাবন নামে এক এমটেক পড়ুয়ার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়। আশানুরুপ চাকরি না মেলায় শ্রাবন আত্মঘাতী হয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছিল।
আইআইটি-র হোস্টেলে বিটেক ও এমটেক পড়ুয়ারা একা ঘরে থাকে। স্বভাবতই সহপাঠীদের সঙ্গে তাঁদের মেলামেশাও কম। তাই পড়ুয়াদের মধ্যে কী ধরনের চিন্তাভাবনা বাসা বাধছে, বা তাঁরা মানসিক চাপে রয়েছে কীনা তা বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তাই পড়ুয়াদের মানসিক চাপ কাটাতেই ‘স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার গ্রুপ’ ও কাউন্সেলিং সেন্টার একসঙ্গে কাজ করবে বলে ঠিক হয়। আইআইটিতে বর্তমানে প্রায় ১১ হাজার পড়ুয়া রয়েছে। অথচ কাউন্সেলিং সেন্টারে কাউন্সেলর রয়েছেন মাত্র ৫ জন। কো-অর্ডিনেটরদের কাজ এই কাউন্সেলর ও পড়ুয়াদের মধ্যে যোগসূত্র রক্ষা করা। কিন্তু প্রতিটি হলে কো-অর্ডিনেটরের সংখ্যাও কম রয়েছে। ফলে তিন-চার জন কো-অর্ডিনেটরের উপর গড়ে ৮০০ জন পড়ুয়ার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে। তাই ছাত্রদের কোনও সমস্যা হলেও নজরদারির অভাবে তা সময়মতো জানা যাচ্ছে না। আইআইটির গবেষক ছাত্র শ্রীতাংশু চক্রবর্তী, বিটেকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আশুতোষ অগ্রবালদের কথায়, “এই আত্মহত্যার প্রবণতা একেবারে নির্মূল করা না গেলেও ছাত্রদের উপর কাউন্সেলিং সেন্টারের একটা বড় প্রভাব রয়েছে। তবে কম সংখ্যক কো-অর্ডিনেটরদের অনেকেই দায় এড়িয়ে চলায় সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া এজন্য নিয়মিত সচেতনতা শিবিরেরও প্রয়োজনীতা রয়েছে। সেদিকে কর্তৃপক্ষ নজর দিলে ভাল হয়”।
আইআইটি-র সুডেন্ট ওয়েলফেয়ার গ্রুপে থাকা গবেষক ছাত্র অভিমন্যু কর বলেন, “পিএইচডি-র পড়ুয়া আর বিটেক বা এমটেক পড়ুয়াদের মানসিক পরিস্থিতি কিছুটা আলাদা। এক্ষেত্রে আগে হলগুলিতে যেভাবে সচেতনতা শিবির করা হত, তা এখন হচ্ছে না। তাছাড়া হল কো-অর্ডিনেটরদেরও সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে কাউন্সেলর কম থাকাতেও সমস্যা হচ্ছে।” খড়্গপুর আইআইটি-র রেজিস্ট্রার তপনকুমার ঘোষাল বলেন, “শুধু পড়াশোনার চাপেই পড়ুয়ারা আত্মঘাতী হচ্ছে এমন নয়। পড়ুয়ারা প্রত্যেকেই মেধাবী। কাউন্সেলিং সেন্টার চললেও অনেক পড়ুয়া সেখানে যেতেই চায় না।” তাঁর কথায়, “কাউন্সেলিং সেন্টারে পড়ুয়ারা উৎসাহী হয়ে এলে আমরাও আরও কাউন্সেলর নিতে পারতাম। এই প্রবণতা কমানোর জন্য আমরা চেষ্টা করছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy