শেষ যাত্রায় মেদিনীপুরের প্রাক্তন পুরপ্রধান। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।
ফোনটা এল পড়ন্ত বিকেলে।
বাইক থামিয়ে দু’কথা বলার ফাঁকেই আমন্ত্রণ, “একবার আসতে পারেন আমার অফিসে?”
পৌঁছতে মিনিট দশেক লাগল। পুরভবনের দোতলার অফিসে ঢুকতেই বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে ডেকে বললেন, “দু’টো কোল্ড ড্রিঙ্কস দিয়ে যা। আর এখন আমি ব্যস্ত থাকবো। কেউ যেন বিরক্ত না করে।”
বন্ধ হয়ে গেল দরজা। ফিসফিস করে বললেন, “একটা কাণ্ড করেছি।”
ততদিনে চেনা হয়ে গিয়েছে গোলগাল টাক মাথার ৫৭ বছরের সদাহাস্য মানুষটিকে। চেহারায় ছাপোষা বাঙালি। কিন্তু তার আড়ালে এক আবেগপ্রবণ, বেপরোয়া যুবক। যিনি যখন তখন যে কোনও ‘কাণ্ড’ করে ফেলতেই পারেন। ততদিনে মেদিনীপুর পুরসভার চেয়ারম্যানের নানা কাণ্ডকারখানা আনন্দবাজারে খবর হয়েও বেরিয়েছে। যা দেখে মেদিনীপুর শহরের অনেকেই এই সাংবাদিকের উদ্দেশে বলেছেন, উনি তো নাজিম আহমেদের লোক।
যেটা তাদের বোঝানো যায়নি, বা বোঝানোর অভিপ্রায়ও হয়নি, তা হল প্রথম দেখাতেই দু’জনের দু’জনকে ভাল লেগে গিয়েছিল। পেশাদার সম্পর্কের বাইরে একটা দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। যে সম্পর্কের খাতিরে রাত দেড়টায় আচমকা বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আইসক্রিম খাওয়ার সাধ হলে নির্দ্বিধায় ফোন করা যেতো তাঁকে। ঘুম ভেঙে তিনিও নির্দ্বিধায় বলতেন, “চলে আসুন।” সেই তিনিই আবার পুরসভার এক কর্মী ‘কে বিবেকানন্দ, ওই পাগড়ি-পরা লোকটা’ বলায় সাসপেন্ড করে দিয়েছিলেন। আহত হয়ে বলেছিলেন, “ভাবতে পারেন বাঙালি, অথচ বিবেকানন্দর নাম জানে না!”
এ হেন একটা লোক যে কাণ্ড বাধাতে সিদ্ধহস্ত সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে অবাক হওয়ার ছিল না। দরজা বন্ধ করে সে দিন ফিসফিস করে বলেছিলেন, “দিন কয়েক আগে এসইবি (রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ) একটা চিঠি দিয়েছে। বলেছে পুরসভার কাছে নাকি প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা (টাকার এই পরিমাণটা একেবারে সঠিক নাও হতে পারে) বকেয়া রয়েছে। এক মাসের মধ্যে টাকা না দিলে সব লাইন কেটে দেবে!”
বকেয়া থাকলে তো মেটাতেই হবে! কী করবেন আপনি!”
“বললাম না, একটা কাণ্ড করেছি!” কাণ্ডের কথাও নিজমুখেই জানালেন তৎকালীন পুরপ্রধান, “আমি আমার লোক লাগিয়ে পুর এলাকার যাবতীয় বিদ্যুতের খুঁটি গুনেছি। ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি, সম্ভবত ১৯১২ সাল থেকে খুঁটি পুতে ব্যবসা করছে এসইবি। অথচ একটি টাকাও পুরসভাকে দেয়নি। আমার এলাকায় কেউ ব্যবসা করলেই তো আমাদের কর দিতে হবে। হিসেব করে দেখেছি, এসইবি-র কাছে পুরসভা উল্টে পাবে প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা! আমি পাল্টা চিঠিতে ওদের জানিয়েছি, আমাদের বকেয়া ৫০ লক্ষ টাকা কেটে বাকি টাকাটা এক মাসের মধ্যে না দিলে আমরা সমস্ত খুঁটি উপড়ে ফেলবো। কী রকম পাল্টা চাল দিলাম বলুন!”
ঘটনাটি আনন্দবাজারে বড় করে ছাপা হয়েছিল। এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে নাজিম আহমেদের চিঠি পাওয়ার পরে এসইবি-র তরফে আর উচ্চবাচ্য করা হয়নি।
‘দুষ্টু বুদ্ধি’র সেই মানুষটাই চলে গেলেন। এমন অসংখ্য ঘটনা মনের মধ্যে ছবির মতো এঁকে দিয়ে অদ্ভুত ভাবেই বিদায় নিলেন। কেন এ ভাবে চলে গেলেন এত স্ফূর্তিবাজ একজন মানুষ! কেন নিজেকে ছুঁড়ে দিলেন ট্রেনের তলায়! এটা ভেবে আফশোস হচ্ছে, যে তাঁর চূড়ান্ত অবসাদের মধ্যে একবার গিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে যদি পারতাম, যদি মনে করিয়ে দিতে পারতাম, ‘আপনি আর দশটা সাধারণ মানুষের মতো নন। আপনার নাম নাজিম আহমেদ। আপনি মানুষকে বাঁচতে শেখান। জীবনটাকে অন্য ভাবে দেখতে জানেন।’
বন্ধু এক সাংবাদিক সে বার মেদিনীপুরে নতুন বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন। এমনিতে প্রচণ্ড গরম। তার উপর সেই সাংবাদিকের ঘরে কম্পিউটার-সহ নানা বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি। ফলে, এসি বসাতেই হবে। কিন্তু, বাধ সাধলেন প্রতিবেশী। তাঁর বক্তব্য, এসি মেশিনের গরম হাওয়া তাঁর বাড়ির দিকে যাবে। খবর পেয়ে হাজির চেয়ারম্যান স্বয়ং। প্রতিবেশীর বাড়িতে ঢুকলেন। এ দিক সে দিক ঘোরার ফাঁকে আচমকা দেখলেন, পিছনের দিকে একটা সিঁড়ি।
চেয়ারম্যানের প্রশ্ন, “এ তো বেআইনি!” থতমত বাড়ির মালিক হাত ঘষছেন। একটু ভেবে নাজিমের রায়, “২০ বছরের পুরনো বাড়ি। প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা করে ২০ লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হবে তো!” প্রতিবেশী তখন ঘেমেনেয়ে অস্থির। বললেন, “স্যার, আমি সাধারণ চাকরি করি। কী করে এত টাকা দেবো!” পুরপ্রধানের জবাব, “তাহলে আমার ভ্রাতৃপ্রতিম সাংবাদিককে বলবো এসি লাগাতে?” আর আপত্তি করেননি ওই প্রতিবেশী।
২০০২ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৫ সালের জুন পর্যন্ত মেদিনীপুরে থাকাকালীন পুরো সময়টা তাঁকে চেয়ারম্যান হিসেবে পাওয়া যায়নি। ২০০৩ সালের শেষ থেকে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ওই পদে ছিলেন না। তখন দেখা হলে নির্ভেজাল আড্ডা দিতেন, কংগ্রেসের সর্তীথদের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির কাহিনি শোনাতেন। ওই সময়টুকু তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন। সেই বেপরোয়া ভাব উধাও। ২০০৪ সালে জনপ্রিয় মানুষটি ফের চেয়ারম্যান হওয়ার পরে ফিরেছিলেন স্বমহিমায়।
স্টেশনের বাইরে রাখা নাজিম আহমেদের মোটর বাইক।
এক দিন রাতে খবর এল নাজিম আহমেদ পুরসভার সিঁড়ির উপরে লণ্ঠন আর লাঠি নিয়ে বসে পাহারা দিচ্ছেন! তখন তিনি চেয়ারম্যান। রাত সাড়ে এগারোটায় পুরসভার সামনে গিয়ে দেখা গেল, সত্যি তিনি সেখানে বসে! ফিক্ করে হেসে বললেন, “কী করবো! পুরসভার ভল্টে টাকা রয়েছে। পাহারাদারেরা কেউ নেই। আমার সঙ্গে মতানৈক্যে তাঁদের গোঁসা হয়েছে। কাজ করবেন না বলে দিয়েছেন। এত টাকা কি আমি ফেলে রাখতে পারি!”
“তা বলে আপনি নিজে পাহারা দেবেন!”
“কাকে বলবো! বললেই তো বলবে আমি চেয়ারম্যান বলে হুকুম করছি। শহরের চোরেরাও তো আমাকে চেনে। তাই নিশ্চয়ই চুরি করতে আসবে না!”
এমনই রঙিন মানুষ ছিলেন নাজিম আহমেদ। কিছু মানুষ থাকেন, যাঁদের স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হয় জীবনভর। চাইলেও মন থেকে ঝেড়ে ফেলা যায় না। কত মানুষের সঙ্গেই তো আলাপ হয়েছে। কথা হয়েছে।
কিন্তু, দশ বছর পরে আজও মোবাইলে জ্বল জ্বল করে তাঁর নম্বর ৯৪৩৪০০৯৭৭৭। যার মধ্যে সাতটি সংখ্যা হুবহু মিলে যায় এই সাংবাদিকের নম্বরের সঙ্গে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy