Advertisement
E-Paper

উঠছে খেলার পাট, মাঠ ডুবে অন্ধকারে

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মাঠে খেলার জন্য দৌড়। ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি- খুদেদের হই হুল্লোড়ে একসময় গমগম করত মেদিনীপুরের মাঠগুলি। মাঠে খেলার এক চিলতে জায়গা মিললেই মনে হত যেন হাতে স্বর্গ এসে গিয়েছে। চিত্রটা এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। খেলাধুলোয় আগ্রহ কমছে ছেলেমেয়েদের। ফলে মাঠগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে। আঁধার নামলেই কোন কোনও মাঠে বসছে মদ্য পানের আসরও।

সুমন ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৫
বেহাল মেদিনীপুর শহরের বার্জটাউনের খেলার মাঠ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

বেহাল মেদিনীপুর শহরের বার্জটাউনের খেলার মাঠ। ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

স্কুল থেকে বাড়ি ফিরেই মাঠে খেলার জন্য দৌড়। ফুটবল, ক্রিকেট, কবাডি- খুদেদের হই হুল্লোড়ে একসময় গমগম করত মেদিনীপুরের মাঠগুলি। মাঠে খেলার এক চিলতে জায়গা মিললেই মনে হত যেন হাতে স্বর্গ এসে গিয়েছে। চিত্রটা এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। খেলাধুলোয় আগ্রহ কমছে ছেলেমেয়েদের। ফলে মাঠগুলো ফাঁকাই পড়ে থাকে। আঁধার নামলেই কোন কোনও মাঠে বসছে মদ্য পানের আসরও। কেন এমন হচ্ছে? এক্ষেত্রে সকলেরই প্রায় এক মত, বর্তমানে স্কুল স্তরে খেলার পাট উঠে গিয়েছে। স্কুল স্পোর্টস ছাড়া খেলাধুলোর মান উন্নয়ন কখনই সম্ভব নয়।

স্কুলেই খেলায় হাতেখড়ি বর্তমানে সিএবি কোচ মেদিনীপুর শহরের বাসিন্দা সুনীল শিকারিয়ার। তাঁর কথায়, “আমার ক্যাম্প থেকেই চলতি বছরে চার জন রাজ্য স্তরে জুনিয়ার বিভাগে খেলার সুযোগ পেয়েছে। জেলায় প্রতিভার অভাব নেই। কিন্তু স্কুল স্তর থেকে প্রতিভা না তোলা হলে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।” স্কুল ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি ভাবেও নানা খেলাধুলোর শিবিরের আয়োজন করা হয়। সেই সমস্ত শিবিরে কেউ কেউ নিজের ইচ্ছেয় হাজির হন ঠিকই, তবে তাতে সার্বিক চিত্রটার কোনও পরিবর্তন হয় না। বাংলা দলের হয়ে ফুটবল খেলা মেদিনীপুর শহরের অমিয় ভট্টাচার্য বলেন, “সামান্য খেলা শিখেই এখন সবাই খেপ খেলতে শুরু করে দেয়। দু’চারশো টাকার জন্য একের পর এক ম্যাচ খেলে নিজের দক্ষতা নষ্ট করে। ভুলেই যেতে বসে ভাল খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন।”

মেদিনীপুর শহরে খেলার মাঠের অভাব রয়েছে এমন নয়। শহরে রয়েছে অরবিন্দ স্টেডিয়াম, মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুল ও কলেজ মাঠ। এর বাইরেও প্রায় প্রতিটি পাড়াতেই রয়েছে বড় বড় মাঠ। তা বার্জটাউন হোক বা শরৎপল্লি, রাঙামাটি হোক বা জেলখানার পুকুর। আগে যে সব জায়গায় নিয়মিত ফুটবল পায়ে একদল ছেলেকে ছুটতে দেখা যেত। কিংবা দেখা যেত ক্রিকেট খেলতে। এখন সেখানেই যুবক-যুবতীদের গল্পে মশগুল থাকতে দেখা যায়। পশ্চিম মেদিনীপুর ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিল ফর স্কুল গেমস অ্যান্ড স্পোর্টস-এর সম্পাদক সোমনাথ দাসের কথায়, “স্কুল থেকেই খেলার চল শুরু না করতে পারলে বিপদ। ভবিষ্যতে ভাল খেলোয়াড় তৈরি একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। তাই আমরা প্রশাসনকে দিয়ে প্রতিটি স্কুলে নিয়মিত খেলা চালু করার জন্য পদক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছি।”

তবে খেলাধুলোয় জেলার ছেলেমেয়েরা অনেক সাফল্যও পেয়েছে। ২০১৩ সালে ১৪ বছরের বালকদের ফুটবলে রাজ্যে জেলা প্রথম হয়েছে। চলতি বছরে জেলা বালকদের ক্রিকেটে প্রথম হয়েছে। ১৭ বছরের বালিকারা সুব্রত কাপে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। আর ১৯ বছরের বালিকাদের ফুটবলেও প্রথম স্থান জেলার। চলতি বছরেই ভদোদরায় কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ের জাতীয় স্তরের প্রতিযোগিতার টেবিল টেনিস বিভাগে স্বর্ণ পদক জিতেছে খড়্গপুরের এরিনা দত্ত। তবে বর্তমানে খেলার সময় এলেই তড়িঘড়ি কয়েকটি স্কুলকে বেছে নেওয়া হয়। ফলে সাফল্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা যায় না। এই কারণেই শহরের মাঠগুলিতে খেলার পরিবর্তে মেলা হতেই বেশি দেখা যায়।

কলেজ কলেজিয়েজ স্কুলের মাঠে বসেছে তাসের আসর।

দেহ সৌষ্ঠবের ক্ষেত্রেও আগে শহরে হাতে গোনা দু’চারটি ক্লাব ছিল। বর্তমানে প্রায় অধিকাংশ ক্লাবেই মাল্টিজিম রয়েছে। রয়েছেন প্রশিক্ষকও। মেদিনীপুর শহরেও একাধিক ক্লাবে অনেক অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তবে সাফল্য অধরাই থাকছে। দেহ সৌষ্ঠবের আন্তর্জাতিক বিচারক রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মতে, “বর্তমান প্রজন্মের সেই লক্ষ্যটাই নেই। তাঁরা জিমে যান কেবলই চলচ্চিত্রের নায়কদের মতো শরীরকে সুন্দর ও সুগঠিত করতে। এর বেশি কিছু লক্ষ্য না থাকার কারণেই এটা হয় না।” আশিতে পা দেওয়া রমাপ্রসাদবাবু যখন প্রশিক্ষণ নিতেন তখন ক্লাব ছিল হাতে গোনা তিনটি। এখান থেকেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি। রমাপ্রসাদবাবুর দাবি, “আমার কাছে নিয়মিত আসত প্রেমচাঁদ। আমি তাঁকে হাতে ধরে অনেক কিছুই শিখিয়েছি। প্রেমচাঁদ মিস্টার ইউনিভার্সও হয়।” মনতোষ রায়, মনোহর আইচের পর প্রেমচাঁদ মিস্টার ইউনিভার্স হন। শহরে একটি ব্যায়ামাগারও তৈরি করেছিলেন তিনি। রমাপ্রসাদবাবুর কথায়, “এক ধরনের ছেলেমেয়ে রয়েছে, যারা পড়াশোনার চাপে এতটাই ভারাক্রান্ত যে এ সবের সময় মেলে না। আর এক ধরনের ছেলেমেয়ে যারা ক্লাবে যায়, তাদের লক্ষ্য নিজেদের সুশ্রী ও সুন্দর রাখা। ফলে ক্লাবে ছেলের সংখ্যা বাড়লেও গুণগত তেমন উন্নতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।”

প্রশ্ন উঠছে, খেলার মান উন্নয়নে ডিস্ট্রিক্ট স্পোর্টস অ্যাসোসিয়েশনের কার্যকারিতা নিয়েও। শহরের স্টেডিয়ামে গ্যালারি সংস্কার, পিচ তৈরি, আলো লাগানোর কাজ হয়েছে। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট ও ফুটবলের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে। কিন্তু খো খো, কাবাডি, হ্যান্ডবল-সহ অন্য খেলাধুলোর ক্ষেত্রে কিছুই নেই। শুধু তাই নয়, অভিযোগ উঠছে, ক্লাবগুলির ক্ষেত্রেও বিবেচনা না করে সাহায্য দেওয়া হয়েছে। মেদিনীপুর শহরের সান্টাফোকিয়া ক্লাবের নাম সকলের জানা। কিন্তু কয়েকবছর হল মূলত দু’টি কারণে ক্লাবটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এক, স্কুলের ছাত্র না পাওয়া আর দ্বিতীয় হল সরকারি সহযোগিতা না মেলা। একই অবস্থা তরুণ সঙ্ঘের ক্ষেত্রেও। সান্টাফোকিয়ার কোচ গৌরীশঙ্কর সরকারের কথায়, “ক্রিকেটে তবু কিছু ছেলে পাওয়া গেলেও ফুটবলে শহরের ছেলেরা একেবারেই আসছে না। তাছাড়াও ক্লাব চালাতে গিয়ে নানা সমস্যাতেও পড়তে হয়। দু’একজন ভাল খেলোয়াড় তৈরি করলেও তাঁদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে অন্য সংস্থা নিয়ে চলে যায়। পরে জানতে পারি, তাঁরা নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তাই স্কুল স্তর থেকে না জোর দিলে এই কাজে সাফল্য পাওয়া খুবই কঠিন।” জেলা ক্রীড়া সংস্থার সহ-সভাপতি আশিস চক্রবর্তী বলেন, “এখন খেলাধুলোর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। ক্যাম্পও হচ্ছে। ফলে সাফল্যও মিলছে। তবে এটাও ঠিক যে, আরও গুরুত্ব দিতে হবে। যাতে খেলার মাঠে সব সময় খেলোয়াড়দের ভিড় থাকে।”

suman ghosh amar shohor midnapore
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy