এ ভাবেই রাস্তা আটকে রাখা থাকে বাইক, সাইকেল। —নিজস্ব চিত্র
ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, নিরাপদ পার্কিং, পানীয় জল থেকে শৌচাগারের সুবন্দোবস্ত আধুনিক বাজারের এই চেহারা মানুষকে ‘শপিং মল’মুখী করে তুলছে। অন্য দিকে, পুরনো আমলের বেশিরভাগ ব্যস্ত বাজারেই গড়ে উঠছে না আধুনিক পরিকাঠামো। খড়্গপুরের প্রাণকেন্দ্র গোলবাজারের ছবিটা আলাদা নয়। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থেকে শৌচাগারের জন্য বারবার দাবি জানিয়েও কোনও সুরাহা হয়নি। আর এ সবের জেরে খদ্দের আসা কমছে, ব্যবসা মার খাচ্ছে বলে অভিযোগ দের।
অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে রেল কারখানার পত্তন শহর খড়্গপুরকে মিশ্রভাষাভাষীর গন্তব্য করে তুলেছিল। বিভিন্ন প্রদেশের মানুষের নানা ধরনের চাহিদার সূত্রে মাড়োয়ারি, গুজরাতি-সহ ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের বহু লোকজনও ভিড় জমিয়েছিলেন রেলশহরে। গড়ে উঠেছিল হরেক সামগ্রীর সুসজ্জিত দোকান। সেই সময়ই শহরের একেবারে মধ্যবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠে গোলবাজার। পত্তনের সময় বাজার ছিল খোলামেলা। বিকিকিনির সুবিধার্থে কাপড়ের দোকানের জন্য ক্লথ মার্কেট, হরেক সামগ্রীর জন্য জনতা মার্কেট, রেডিমেড পোশাকের জন্য হকার্স মার্কেট, সব্জির জন্য সব্জি মার্কেট গড়ে তোলা হয়। তখন বাজারের পথঘাটও ছিল বেশ চওড়া। পরবর্তী কালে দোকানের সংখ্যা ক্রমে বেড়েছে। এখন প্রায় আড়াই হাজার দোকান রয়েছে গোটা গোলবাজারে। এর মধ্যে অনেকগুলিই রেলের। বাজার জুড়ে প্রায় ছ’শো অবৈধ দোকানও গজিয়ে উঠেছে।
পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘিঞ্জি হয়ে উঠেছে বাজার। আর সংকীর্ণ হয়েছে রাস্তা। পার্কিংয়ের নির্দিষ্ট জায়গা না থাকা গোলবাজারের শতাব্দী প্রাচীন সমস্যা। বাজারের মধ্যেই গাড়ি, মোটর সাইকেল, সাইকেল, রিকশা অবিন্যস্ত ভাবে দাঁড় করানো থাকে। যাতায়াত করতে গিয়ে ঠোক্কর খেতে হয়। তার জেরে বচসা থেকে অশান্তিও হয় প্রতিনিয়ত। সমস্যা সব থেকে বেশি হকার্স মার্কেট, নিউ মার্কেট, সুইট ইন্ডিয়া, ক্লথ মার্কেট, হান্ডি মার্কেট, ভাণ্ডারি চক, ভুসিমাল মার্কেটে। সব মিলিয়ে আখেরে মার খাচ্ছে ব্যবসা। খদ্দেররা নির্ঝঞ্ঝাট বাজার করতে পারছেন না। ফলে, অনেকেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছুটছেন নিউ সেটলমেন্ট এলাকার শপিং মলে বা ছোট ছোট বাজারে। হকার্স মার্কেটের বাইরে নিউ মার্কেটের ব্যবসায়ী বাবু সরকারের কথায়, “প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ আসছেন। কে কখন দোকানের সামনে গাড়ি-সাইকেল দাঁড় করে যাচ্ছে বুঝি না। খদ্দের দোকানে ঢোকার পথ না পেয়ে অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছে। ব্যবসা করব না লড়াই করব? রেল তো শত আবেদনেও সাড়া দেয়নি।”
গোলবাজারের আর এক সমস্যা শৌচাগার না থাকা। বাজারের আসা মহিলাদের কথা চিন্তা করেও এ বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনি রেল। আবার আধুনিক ব্যবসার প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সংযোগও নেই বাজারে। রেলের লাইসেন্সপ্রাপ্ত আড়াই হাজার দোকানের প্রায় ৯০ভাগ দোকানই জেনারেটরের উপর নির্ভরশীল। নেই নলবাহিত জলের সংযোগও।
বাজারের দায় রেল কর্তৃপক্ষ না পুরসভার, তা নিয়ে রয়েছে চাপানউতোর। ২০১০ সালে রেল এলাকা পুরসভার অধীনে এসেছে। শহরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছে এই গোলবাজার। বাজারের হাল ফেরানো নিয়ে তাই ব্যবসায়ী থেকে ক্রেতা, সকলেই পুর-কর্তৃপক্ষের উপর আশা রাখছে। যদিও পুরসভা এ ক্ষেত্রে রেলকেই দেখাচ্ছে। পুর-কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, রেল জমি হস্তান্তরে রাজি নয়। তাই অনুমতির অভাবে কিছু করা যাচ্ছে না। কিন্তু বাজার বাদে কিছু রেল বস্তি এলাকায় সম্প্রতি বিদ্যুৎ ও নলবাহী জল সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে পুরসভা। বাজারের যাতে এমন পুর-উদ্যোগ হয় ব্যবসায়ীদের সেটাই দাবি। চেম্বার অফ কমার্সের গোলবাজার ইউনিটের সম্পাদক টিঙ্কু ভৌমিক বলেন, “পার্কিং, জল, শৌচাগার ও বিদ্যুৎএই চার দফা দাবি পূরণে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের লড়াই চলছে। কিন্তু রেল আমাদের দাবি পূরনে উদাসীন। এখন এলাকাটি পুরসভার অধীনে আসায় পুরসভার উপরে আশা বাড়ছে।” যদিও পুরপ্রধান রবিশঙ্কর পাণ্ডের বক্তব্য, “বাজারের দায়িত্ব সম্পূর্ণ রেলের। তাই পুর এলাকা হওয়া সত্ত্বেও রেল জমি না দেওয়ায় পার্কিংয়ের সমস্যা মেটাতে আমরা অক্ষম।” তবে বাজারে জল ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করার আশ্বাস দিয়েছেন পুরপ্রধান।
রেল যে একেবারে উদ্যোগী হয়নি তা-ও কিন্তু নয়। বিভিন্ন সময় বৈঠক হয়েছে। ২০১৩ সালের গোড়ায় গোলবাজারের গুজরাতি মিত্র মণ্ডপে একটি আলোচনায় বসেন রেল কর্তৃপক্ষ। সেই সময় পার্কিংয়ের জন্য রবীন্দ্র ইনস্টিটিউটের ময়দান, তিন নম্বর রেল কোয়ার্টার সংলগ্ন ফাঁকা জমি-সহ তিনটি জায়গায় পার্কিংয়ের প্রস্তাব দেয় ব্যবসায়ীরা। তারপরে কাজও এগোয়। কিন্তু রেলের ডিআরএম বদলের সঙ্গে সঙ্গেই চাপা পড়ে যায় পরিকল্পনা। খড়্গপুরের ডিআরএম গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “আমার মনে হয় যখন বাজার গড়ে উঠেছিল সেই সময় সব পরিকাঠামো ছিল। কিন্তু সেগুলির অপব্যবহার হয়েছে। পার্কিংয়ের ভাবনাচিন্তা আমাদের রয়েছে। তবে এখনই কোনও পরিকল্পনা নেই। আর সব দোকানে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর মতোও এই মুহূর্তে কোনও পরিকাঠামো নেই।” স্বভাবতই ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা। জেলা ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক রাজা রায় বলেন, “বৈঠকের পরেও কেন পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রেল করতে পারল না তা আমাদের অজানা। কিছুদিনের মধ্যেই পার্কিং, জল, বিদ্যুৎ, শৌচাগার নিয়ে আমরা লাগাতার আন্দোলনে নামব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy