খড়্গপুর স্টেশন চত্বর। রেলশহরের ব্যস্ততম এলাকা। স্টেশনের সামনেই মোটর বাইক রেখে দোকানে গিয়েছিলেন বাপ্পা ঘোষ। দোকান থেকে ফিরে এসে দেখেন বাইকটি নেই। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে পেশায় এক মোবাইল সংস্থার কর্মী বাপ্পার।
খড়্গপুর মহকুমা হাসপাতাল চত্বর। এখানেও দিনভর মানুষের ভিড় থাকে। হাসপাতাল চত্বরে মোটর বাইক রেখে এক চিকিৎসকের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন পলাশ লাহা। ফিরে এসে তিনি দেখেন বাইক উধাও। কী করবেন, গোড়ায় তা ভেবেই পাচ্ছিলেন না পেশায় এক ওষুধ সংস্থার কর্মী পলাশ।
এই দু’টি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, মেদিনীপুর-খড়্গপুরের মতো শহরে প্রায়ই এ ভাবে মোটর বাইক চুরির ঘটনা ঘটছে। গত সোমবারও মেদিনীপুর শহরের বাইক চুরির ঘটনা ঘটেছে। কিনারা অবশ্য এখনও হয়নি। ঘটনায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। যাঁদের বাইক এ ভাবে খোওয়া গিয়েছে, তাঁদের অনেকেরই অভিযোগ, ঘটনার কথা পুলিশকে জানালেও কোনও লাভ হয় না। পুলিশ ‘দেখছি-দেখবো’ বলেই দায় এড়ায়। মেদিনীপুর শহরের থেকে বাইক চুরির ঘটনা বেশি ঘটছে রেলশহর খড়্গপুরে। তল্লাশি-অভিযানে নেমে পুলিশ কিছু বাইক উদ্ধার করছে। তবে তা চুরি যাওয়া বাইকের সংখ্যার তুলনায় নামমাত্র।
এ ক্ষেত্রে কি পুলিশের নজরদারির অভাব রয়েছে? পুলিশের বক্তব্য, নজরদারি চলে। তারমধ্যেই কিছু দুষ্টচক্র চুরির ফাঁদ পাতে। পরিস্থিতি দেখে মোটর বাইক চুরি রুখতে এ বার সাদা পোশাকের পুলিশকেও পথে নামানো হতে পারে। জেলা পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ বলেন, “কিছু বাইক চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরির কিনারা করতে তদন্তও চলছে। ইতিমধ্যে চুরি যাওয়া কিছু বাইক উদ্ধারও করা হয়েছে।” জেলা পুলিশের এক কর্তা জানিয়েছেন, দুই শহরেই বেশ কিছু দুষ্টচক্র বাইক চুরির কাজে জড়িত। কয়েকজনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। তবে, পান্ডাদের পাকড়াও করা যায়নি।
দুই শহর এবং শহরতলিতে মোটর বাইক চুরি নতুন নয়। এই ধরনের ঘটনা সব থেকে বেশি ঘটে দুর্গাপুজোর মরসুমে। ওই সময় বাইক রেখে অনেকেই দীর্ঘক্ষণ কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। সেই সুযোগে বাইক নিয়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। এখন অবশ্য অন্য মরসুমেও বাইক চুরি বেড়েছে। পুলিশের একটি সূত্রে খবর, স্থানীয় চোরদের ব্যবহার করে পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার কিছু দুষ্কৃতী এই চক্র চালাচ্ছে। চুরি করা বেশ কিছু মোটর সাইকেলের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হচ্ছে ছোট মাছ ধরার নৌকো ও ভুটভুটিতে। দুই শহরেই দিনেদুপুরে বাড়ির সামনে থেকে, অফিসের সামনে থেকেও মোটর বাইক চুরির হচ্ছে। জনবহুল এলাকায় সকলের নজর এড়িয়ে যে ভাবে বাইক চুরি হচ্ছে, তা ভাবাচ্ছে পুলিশকে।
শহর এবং শহরতলিতে এখন মোটর বাইকের সংখ্যাও আগের থেকে অনেক বেড়েছে। দুই শহরে প্রায় সব বাইক প্রস্তুতকারী সংস্থারই নিজস্ব ডিলার রয়েছে। রয়েছে শোরুমও। বিভিন্ন ঋণদানকারী সংস্থাও যুবকদের ঋণ দিয়ে বাইক কিনতে সাহায্য করছে। ফলে, দিনে দিনে শহর এবং শহরতলিতে মোটর বাইকের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। পুলিশেরই এক সূত্রে খবর, খড়্গপুরের মতো শহরে কোনও মাসে ৭-৮টি করে বাইক চুরি যাচ্ছে। মেদিনীপুরে ৪-৫টি করে বাইক চুরি যাচ্ছে। সদর শহরে দু’দিনে ৭টি বাইক চুরির ঘটনাও ঘটেছে। স্বভাবতই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন শহরের অনেক বাসিন্দা। বিশেষ করে যাঁদের মোটর বাইক রয়েছে। এক-একটি বাইকের দামও তো কম নয়। দুই শহরের নতুন প্রজন্মই এখন দামি মোটর বাইকে মজেছে। বাইকের দাম ৫০-৬০ হাজার টাকা থেকে শুরু। লক্ষাধিক টাকাতেও বিকোচ্ছে বাইক।
পুলিশেরই এক সূত্রে খবর, আগে ধরা পড়া চোরচালানচক্রের সঙ্গে জড়িতদের জেরা করে জানা গিয়েছে, মেদিনীপুর শহরে বাইক চুরির সঙ্গে জড়িত দুষ্টচক্রের সংখ্যা কম। খড়্গপুর শহর এবং খড়্গপুর গ্রামীণ এলাকায় এই দুষ্টচক্রের সংখ্যা বেশি। মাস তিনেক ধরে কৌশল্যা বাজার, পুরাতনবাজার, দেবলপুর, গোলবাজার, বারবেটিয়া থেকে একের পর এক মোটরবাইক চুরি হয়েছে। বারবেটিয়ার হিরোজ মাইতি, কৌশল্যার নরেন্দ্রনাথ ঘোষ রায়, ধানসিংহ ময়দানের শ্রীনাথ রাও-সহ প্রায় ১৬ জনের মোটর সাইকেল নিয়ে চোরেরা চম্পট দিয়েছে। ১১টি অভিযোগ এসেছে টাউন থানায়। তার মধ্যে মাত্র তিনটি বাইক উদ্ধার হয়েছে। চন্দ্রকোনা রোডেও সক্রিয় বাইক চুরি চক্র রয়েছে। একবার কোতয়ালি থানার পুলিশ রোডের একটি এলাকা থেকে বেশ কিছু চুরি যাওয়া বাইক উদ্ধারও করে। পুলিশ জানিয়েছে, চোরাই মোটর বাইকের খোঁজে তল্লাশি-অভিযান চালানো হয়। এ বার সেই অভিযানে আরও গতি আনা হবে। বাইক চুরি রুখতে এ বার সাদা পোশাকের পুলিশকেও পথে নামানো হতে পারে।
খড়্গপুর স্টেশন চত্বরের সামনের এলাকা থেকে যাঁর বাইক চুরি গিয়েছে, পেশায় এক মোবাইল সংস্থার কর্মী সেই বাপ্পা বলছিলেন, “বাইক রেখে একটি দোকানে গিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ পরই ফিরে আসি। এই সময়ের মধ্যেই যে বাইকটি উধাও হয়ে যাবে, ভাবতে পারিনি! পুলিশকে জানিয়েছি। অবশ্য এখনও পর্যন্ত খোওয়া যাওয়া বাইকের হদিস মেলেনি!” পথে সাদা পোশাকের পুলিশ নামিয়ে বাইক চোরাচালান চক্রগুলোর রাশ টেনে ধরা যায় কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy