Advertisement
১১ মে ২০২৪

নাতনিতেই বেশি বিভোর নিশ্চিন্ত শিশির

এক জন সকাল হলেই মোটরবাইক ছুটিয়ে যাচ্ছেন এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে। আর এক জন ‘শান্তিকুঞ্জে’র আরামকেদারায় নাতনির সঙ্গে খুনসুটিতেই ব্যস্ত। এক জন ৯০০ উঠোন-বৈঠক আর ৬৮টা রোড-শো সেরে ফেলেছেন। অন্য জন বিকেলে রোদ পড়লে সভা করছেন মেরেকেটে দু’টো কি তিনটে। এক জনের বক্তব্য, “এ লড়াই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই।” অন্য জনের ভোট নিয়ে কথা বলতেই চূড়ান্ত অনাগ্রহ। জোরাজুরিতে এটুকু জানাচ্ছেন যে, ব্যবধান আরও কিছুটা বাড়লেই তিনি খুশি।

মঙ্গলবার নাতনির সঙ্গে নিজের বাড়িতে ব্যস্ত শিশির অধিকারী। —নিজস্ব চিত্র

মঙ্গলবার নাতনির সঙ্গে নিজের বাড়িতে ব্যস্ত শিশির অধিকারী। —নিজস্ব চিত্র

জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৪৫
Share: Save:

এক জন সকাল হলেই মোটরবাইক ছুটিয়ে যাচ্ছেন এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামে। আর এক জন ‘শান্তিকুঞ্জে’র আরামকেদারায় নাতনির সঙ্গে খুনসুটিতেই ব্যস্ত।

এক জন ৯০০ উঠোন-বৈঠক আর ৬৮টা রোড-শো সেরে ফেলেছেন। অন্য জন বিকেলে রোদ পড়লে সভা করছেন মেরেকেটে দু’টো কি তিনটে।

এক জনের বক্তব্য, “এ লড়াই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই।” অন্য জনের ভোট নিয়ে কথা বলতেই চূড়ান্ত অনাগ্রহ। জোরাজুরিতে এটুকু জানাচ্ছেন যে, ব্যবধান আরও কিছুটা বাড়লেই তিনি খুশি।

এক জন তাপস সিংহ, কাঁথি লোকসভা কেন্দ্রের সিপিএম প্রার্থী। অন্য জন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা পূর্ব মেদিনীপুরের ‘অধিকারী সাম্রাজ্যে’র সর্বাধিনায়ক শিশির অধিকারী। যিনি ’৬২ সাল থেকে ভোটে লড়ছেন। এবং যিনি বলছেন, ভোটে জিততে তাঁকে আর আলাদা করে পরিকল্পনা করতে হয় না।

নিবাস শান্তিকুঞ্জের বসার ঘরে মা তারার প্রকাণ্ড এক ছবির নীচে তাঁর আরামকেদারা। স্যান্ডো গেঞ্জি, নীল-সাদা চেক লুঙ্গি আর আর হাতে লিকার চায়ের গ্লাস হাতে মেজাজে আসীন অধিকারী কর্তা। যদি শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ কোনও নেতার চেহারা ভেবে বসেন, ভুল করবেন। ইনি আপাদমস্তক তৃপ্ত গৃহস্বামী। কীসের ভোট? এঁর দিনরাত জুড়ে শুধুই একরত্তি নাতনি।

নাতনি পিয়ানের বয়স পাঁচ মাস। দক্ষিণ কাঁথির বিধায়ক তথা অধিকারী বাড়ির সেজ ছেলে দিব্যেন্দুর কন্যা। সেই পিয়ানের ঠাকুর্দা বলছেন, “আর বলবেন না, এখন আর স্বাধীনতা নেই। পিয়ানই ঠিক করে, কখন বাড়ি থেকে বেরোব, কখন ফিরব। ভোটের প্রচার করব কি, ওর জন্যই তো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে আসতে হয়। রাতে শুতে যাওয়ার আগে আমার কোলে চড়তেই হবে। না হলে ওই একরত্তি মেয়ে কিছুতেই ঘুমোবে না। বাইরে থাকলে তাই মন টানে ওর জন্য। ভাবি, নাতনিটা এখনও জেগে। তাই সকাল সকাল ফিরে আসতে হয়।”

কিন্তু ভোটে...

শিশিরবাবু বলে যাচ্ছেন, “চার ছেলের বাপ আমি। এক নাতি ক্লাস সেভেনে পড়ে। কিন্তু এই যে দুষ্টুটা এসেছে, ও সব পাল্টে দিয়েছে। আমি দুধের বোতল না ধরলে কিছুতেই খাবে না। বৌমা ওকে খাওয়াতেই পারে না। সটান আসে আমার কাছে। শিশির অধিকারী কিনা হাতে বোতল ধরে নাতনিকে খাওয়াচ্ছে!”

ঠিক। এই ছবিটাই তো মিলছে না। ভোট শিয়রে, অথচ শিশির অধিকারীর মতো এমন ভীষণরকম রাজনৈতিক চরিত্র এত নির্বিকার রয়েছেন কী করে? তিনি কি পণ করেছেন যে, ভোট নিয়ে কোনও কথাই বলবেন না?

“ধুর, ধুর। সব কাজ শেষ। ৮২% পঞ্চায়েত জিতেছি। এর পরেও আলাদা করে নামতে হবে নাকি?” চূড়ান্ত অবজ্ঞায় পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন শিশিরবাবু। অনেকে যে বলছেন, খেজুরি, পটাশপুর আর মুগবেড়িয়ায় তৃণমূলের একাধিপত্যর জন্যই আপনি এত নিশ্চিত? ওখানে নাকি সুষ্ঠু ভোটই হবে না?

অবশেষে, এই প্রথম একটু সিরিয়াস দেখাল তাঁকে। এবং জানালেন, তাঁদের যতই আধিপত্য থাক, সিপিএমের ভোট কিন্তু মরে যায়নি। কিছু ভোট তারা পাবে। তৃণমূল যদি সংগঠনের জোরে নিজেদের ভোটটা ঘরে তুলতে পারে, তা হলেই চিন্তা নেই। বললেন, (পিয়ানের ঠাকুর্দা এ বার পুরোপুরি রাজনীতিক), “আমরা ৩৬৫ দিন মানুষকে নিয়ে চলি। মেয়ের বিয়েতে সাহায্য করা থেকে বেকারদের কাজ জোগাড় করে দেওয়া, হাসপাতালে ভর্তি করা থেকে ব্যবসায় ব্যাঙ্ক ঋণের ব্যবস্থা, সবই করতে হয়। ফলে ভোটে জিততে আমাকে বিশ্ব রাজনীতির কথা বলতে হয় না। আমি লোকাল হিরো হয়েই থাকতে চাই।”

বিশ্ব রাজনীতির খোঁচাটা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী, সিপিএমের তাপস সিংহকে। এলাকায় বিতরিত বাম প্রার্থীর সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে লেখা আছে, বিশ্ব যুব আন্দোলনে তাঁর ভূমিকার কথা। তাপসবাবু কিন্তু খোঁচাটা গায়ে মাখলেন না। বললেন, “আমার পরিচিতিপত্র পার্টি অনুমোদিত। তিন বার বিশ্ব যুব আন্দোলনের কো-অর্ডিনেটর নির্বাচিত হয়েছি। কিছু অভিজ্ঞতা

তো হয়েছে।” ভগবানপুর জোনাল কমিটির অফিসে বসে যুব নেতা জানালেন, প্রথম দিকে কোথাও তাঁদের প্রচার বাধা পায়নি। কিন্তু ভোট এগিয়ে আসতেই আক্রমণ শুরু করছে ‘ওরা’। তাপসবাবুর কথায়, “ভাজাচাউলিতে প্রচার গাড়ি ভেঙে দিয়েছে। প্রকাশ্যে অপরাধীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তবু লড়াইয়ে আছি। জোর লড়াই হবে এ বার।”

যদিও এই পার্টি অফিস খুঁজতে গিয়েই বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হল। দিঘাগামী রাস্তায় বাজকুল মোড় থেকে ডান হাতে ঘুরে ভগবানপুর। জানা ছিল, এই চত্বরেই চাঁদিফাটা রোদে প্রচার করছেন সিপিএম প্রার্থী। কিন্তু ঠিক কোথায় তিনি? মোবাইলে প্রার্থীর জবাব, “একেবারে ভিতরে। এখানে পৌঁছতে পারবেন না। চলার অযোগ্য রাস্তা। বাইক নিয়ে ঘুরছি।” আপনার প্রচার দেখতে চাই যে! উত্তর এল, “এত দুর্গম এলাকায় আসতে পারবেন না। বরং ভগবানপুর জোনাল অফিসে বসুন, দেখা হবে।”

অগত্যা কাজলাগড় বাজারে এক প্রবীণের কাছে জানতে চাওয়া, “সিপিএমের পার্টি অফিসটা কোথায় বলতে পারেন?” পাল্টা প্রশ্ন এল “আমাকে কি দেখে মূর্খ মনে হয়?”

মানে???

আরও ঝাঁঝিয়ে জবাব আসে, “এ তল্লাটে মূর্খরাই সিপিএমের খোঁজ রাখে!” আরও এগিয়ে কলাবেড়িয়া বাজারে কালভার্টের উপরে বসেছিলেন জনা কয়েক যুবক। পার্টি অফিসের কথা তুলতেই একেবারে রে রে করে উঠলেন “এখানে সিপিএম বলে কিছু নেই। চলে যান এখান থেকে।” আঁচ করার চেষ্টা করলাম, ভগবানপুরের জনবহুল এলাকাতেই যদি এই অবস্থা, তা হলে তাপসবাবু যে গণ্ডগ্রামে প্রচার করছেন, সেখানকার না জানি কী হাল।

বাম প্রার্থী অবশ্য পরিস্থিতি অতটা খারাপ বললেন না। জানালেন, দিঘা থেকে রামনগর, খেজুরি থেকে মুগবেড়িয়া, চণ্ডীপুর থেকে পটাশপুর সর্বত্রই প্রচার হয়েছে। এ-ও দাবি করলেন, অধিকারীদের বিরুদ্ধে চাপা ক্ষোভ রয়েছে সকলের। টেট কেলেঙ্কারি, সারদা কেলেঙ্কারির প্রভাবও পড়ছে। ফলে তাক লাগিয়ে দেওয়া ফলাফল হবে।

কংগ্রেস প্রার্থী কুণাল বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য তাক লাগিয়ে দেওয়ার কোনও স্বপ্ন দেখছেন না। তাঁর কথায়, “এই চত্বরে হাত চিহ্নটাই লোকের স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছে। আমি কোনও স্বল্পকালীন প্রাপ্তির জন্য লড়ছি না। কংগ্রেসকে এই তল্লাটে প্রতিষ্ঠা করার একটি ধাপ এই নির্বাচন।” জেলা কংগ্রেসের অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে রাহুল গাঁধীর মনোনীত প্রার্থীকে নিয়ে নানা কথা। রাহুলের নির্দেশ পেয়ে গত ১৫ মার্চ তমলুকে এসেছিলেন কুণাল। জেলা নেতাদের জানিয়েছিলেন, হাইকম্যান্ড তাঁকেই প্রার্থী করতে চায়। কানে তোলেননি জেলা নেতারা। তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়, যখন প্রার্থী পদ ঘোষিত হবে, তার পরে আসবেন। কুণাল ফিরে যান। ২২ মার্চ প্রার্থী তালিকা প্রকাশিত হওয়ার পর ফের জেলায় আসেন তিনি। কাঁথির মনোহরচকের অস্থায়ী আস্তানা থেকে প্রায় একাই লড়তে হচ্ছে কুণালকে। দক্ষিণ বেঙ্গালুরু কেন্দ্রে নন্দন নিলেকানির অন্যতম ভোট ম্যানেজার বেঙ্কটেশকে কাঁথিতে পাঠিয়েছে হাইকম্যান্ড। কুণালের এলাকা দেখে তাজ্জব বনে গিয়েছেন তিনি। বলেছেন, “ওহ মাই গড, ইটস অ্যাবসলিউট ‘অডিকারি ব্যাস্টন’।” বাস্তবিক। এখানে রাহুলের পাশাপাশি অনুপস্থিত নরেন্দ্র মোদীও। বিজেপি প্রার্থী কমলেন্দু পাহাড়ির প্রচারের দেখা মিলছে কদাচিৎ। মনে হয়, হয়তো ঠিকই বলেছেন ‘লোকাল হিরো’। যাঁর দাপটে সাগরতটে রাহুল কিংবা মোদীর হাওয়াও নিস্তেজ।

আর তাই দেশের চমকপ্রদ রাজনৈতিক যুদ্ধেও নিস্পৃহ শান্তিকুঞ্জের আরামকেদারার মালিক। কী অবলীলায় বলছেন, “পুরো বাঁধা পড়ে গিয়েছি। আমারও যে এই হাল হবে, কখনও ভাবিনি!” প্রসঙ্গ, পুঁচকে পিয়ান। ভাল নাম দীপান্বিতা। তার বাবা দিব্যেন্দু বলছিলেন, “বাবার (শিশিরবাবু) আরাধ্যা মা কালী। প্রতি বার নিরম্বু উপবাস শেষে ধুমধাম করে কালীপুজো করেন। গত বার কালীপুজোর তিন দিন আগে আমার মেয়ে হল। নাম রাখলেন দীপান্বিতা। বাবা মনে করেন ঘরে সাক্ষাৎ কালী এসেছে।”

তিনটে মোবাইলে অবিরাম মেসেজ আসছে। খবর আসছে বিভিন্ন গ্রাম থেকে। অল ইজ ওয়েল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।

ঠাকুর্দা তাই পিয়ানেই ব্যস্ত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE