যুযুধান দু’পক্ষের মুখেই ঘুরে ফিরে সেই সন্ত্রাসের কথা। জঙ্গলমহলের জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরে লোকসভা ভোটের প্রচারে তৃণমূলের হাতিয়ার যেখানে ‘পুরনো সন্ত্রাস’, সেখানে বামেরা প্রচারে টানছে ‘টাটকা সন্ত্রাস’-এর প্রসঙ্গ। তৃণমূল শিবির আওয়াজ তুলছে, ‘সিপিএমের সন্ত্রাস আমরা ভুলিনি, ভুলবো না।’ আর প্রধান বিরোধী শিবির স্লোগান তুলছে, ‘বন্দুকের গুলি খাই-লাঠি খাই, বামফ্রন্টের ভয় নাই।’
একটা সময় জেলার জঙ্গলমহলে নাশকতা ছিল রোজকার ঘটনা। তবে মাওবাদী শীর্ষ নেতা কিষেনজির মৃত্যুর পরে পরিস্থিতি পাল্টেছে। জঙ্গলমহল এখন শান্ত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই শান্তি ফেরানোকে তাঁর সরকারের অন্যতম কৃতিত্ব হিসেবে দাবিও করেন। তা সত্ত্বেও ভোট-প্রচারে তৃণমূল সেই সন্ত্রাসের কথাই বলছে। কিন্তু কেন? তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায়ের জবাব, “আজ জেলায় যে জিনিসটা অত্যন্ত সহজ বলে মনে হচ্ছে, ১৯৯৮ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কিন্তু তা ছিল না। কী করে আমরা ভুলে যাবো গড়বেতা- কেশপুরের কথা? লালগড়-নেতাইয়ের কথা? গত লোকসভা ভোটের সময়ও জঙ্গলমহল রক্তাক্ত। আর আজ সব শান্ত। আমরা অনেক কষ্টে গণতন্ত্র ফেরত পেয়েছি! একে রক্ষা করতে হবে।” আর জেলা বামফ্রন্টের আহ্বায়ক তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপক সরকারের অভিযোগ, “রাজ্যে পরিবর্তনের পর সর্বত্র সর্বাত্মক আক্রমণ ও চক্রান্ত শুরু হল। আমাদের কর্মী-সমর্থকেরা আক্রান্ত হলেন। পুলিশ আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই মিথ্যে মামলা করল। ২০০৯ সালেও তৃণমূল-মাওবাদী আঁতাতে জেলা রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। আমাদের উপর আক্রমণ নেমে এসেছিল। তা-ও আমরা জেলার তিনটি লোকসভা আসনেই জয়যুক্ত হয়েছি। এ বারও পারব।”
পশ্চিম মেদিনীপুরের সন্ত্রাসের দলিল নেহাত ছোট নয়। ১৯৯৮-’৯৯ থেকে ২০০৮-’০৯ ক্রমান্বয়ে সন্ত্রাসের অভিযোগ উঠেছে এই জেলায়। ২০০০ সালের লোকসভা উপ-নির্বাচনে তৎকালীন পাঁশকুড়া (আজকের ঘাটাল) থেকে হেরে গিয়েছিলেন সিপিআইয়ের গুরুদাস দাশগুপ্ত। অথচ, তার দু’বছর আগে এখান থেকেই বিপুল ভোটে জয়ী হন গীতা মুখোপাধ্যায়। এই জয়-পরাজয়ের মধ্যে ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়ায় অগ্নিগর্ভ কেশপুর। সেখানে তখন সিপিএম-তৃণমূলের মধ্যে এলাকা দখলের লড়াই চলছে। ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ফের অন্য সমীকরণ। সে বার কেশপুর থেকে লক্ষাধিক ভোটে জেতে সিপিএম। কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্থানে জেলার গড়বেতা-কেশপুরে রাজনৈতিক কার্যকলাপ বড় ভূমিকা নিয়েছে বলে মনে করেন অনেকেই। সেই পর্বে সিপিএমের বিরুদ্ধে লাগাতার সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছিলেন মমতা।
পরবর্তী পর্যায়ে ছিল মাওবাদী সন্ত্রাস। ২০০৮-’০৯ থেকে রাজ্যে পালাবদলের আগে পর্যন্ত জঙ্গলমহলে লাগাতার নাশকতা চালিয়েছে মাওবাদীরা। বহু মানুষ খুন হয়েছেন। অনেক রক্ত ঝরেছে। বামেদের অভিযোগ, সেই পর্বে মাওবাদীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল তৃণমূল। এই অভিযোগের সমর্থনে বামেদের যুক্তি, সেই সময় মাওবাদীদের সঙ্গে এক সুরে যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের দাবিতে সরব হয়েছিল তৃণমূল। আর তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরই মাওবাদীদের হিংসাত্মক কাজকর্মে দাঁড়ি পড়েছে। তৃণমূলের পাল্টা অভিযোগ, জঙ্গলমহলে অশান্তির বীজ পুঁতে ছিল সিপিএম। বিভিন্ন এলাকায় সশস্ত্র বাহিনীর শিবির তৈরি করে মানুষের উপর অত্যাচার চালানো হয়।
লোকসভা ভোটের আগে এই সন্ত্রাস-কথা তুলে ধরেই প্রচার চালাচ্ছে বাম-তৃণমূল দু’পক্ষ। সভা-সমাবেশে জেলা তৃণমূলের সভাপতি দীনেনবাবু বলছেন, “মানুষ যা চেয়েছেন, এই আড়াই বছরে তার থেকেও বেশি পেয়েছেন। এই সময়ের মধ্যে জঙ্গলমহলে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। উন্নয়নের কর্মযজ্ঞও শুরু হয়েছে।” তাঁর কথায়, “আগে জঙ্গলমহলে বছরে ১৮০ দিন বন্ধ হত! মানুষ দুর্ভোগে পড়তেন। এখন সেই পরিবেশ নেই। এটা কি আমাদের সরকারের সাফল্য নয়? চাঁদড়ার বুধন মুর্মুকে কারা খুন করেছে? নয়াগ্রামের কাঁদন হাঁসদাকে কারা খুন করেছে? মানুষ এত সহজে সব ভুলে যাবে?”
অন্য দিকে, সিপিএমের জেলা সম্পাদক দীপকবাবু বলছেন, “একটা সময় উনি (মুখ্যমন্ত্রী) নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া লালগড়-রামগড়ে গিয়েছেন। আর আমাদের একজন পার্টি কর্মীর দেহ রামগড়ে নিয়ে যেতেও বাধা পেতে হয়েছে। শববাহী গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়েছে। কেন এমন পরিস্থিতি হয়েছিল, তা মানুষ জানে।” তিনি বলছেন, “২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে নতুন সরকারের প্রতিষ্ঠা মানুষের মধ্যে অনেক প্রত্যাশা জাগিয়ে ছিল। কিন্তু, আমাদের জেলায় এই সরকারের পথ চলা শুরুই তো গড়বেতার জীতেন নন্দীকে খুন করে। আমরা কী দেখছি? ওদের (তৃণমূলের) নেতা-নেত্রীরা হামলে পড়েছে পঞ্চায়েতের অর্থ লুঠ করার জন্য। মানুষকে হুকুম মতো চলতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার লুঠ করা অর্থের ভাগ-বাঁটোয়ারা নিয়েও ওদের তুমুল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মানুষের জীবন নাজেহাল হয়ে উঠছে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy