Advertisement
২২ মে ২০২৪

পুরনো প্রেমবাজারই ঠিকানা প্রেমের

ভালবাসার মতোই ভালবাসার দিন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন অনেকেই। বাঙালির কাছে প্রেমের দিন বললেই মনে হয়, বসন্ত পঞ্চমীর দিন হলুদ শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে একসঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া, অন্য স্কুলে ঢুঁ মারা, আর বন্ধু-বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরনোর জন্য বাড়ির অনুমতি পাওয়া।

গোলবাজারে কার্ডের বিকিকিনি।

গোলবাজারে কার্ডের বিকিকিনি।

দেবমাল্য বাগচি
খড়গপুর শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:২২
Share: Save:

“...এখনও বুঝি না ভালো,

কাকে ঠিক ভালবাসা বলে।”

—শঙ্খ ঘোষ।

ভালবাসার মতোই ভালবাসার দিন নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেন অনেকেই। বাঙালির কাছে প্রেমের দিন বললেই মনে হয়, বসন্ত পঞ্চমীর দিন হলুদ শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে একসঙ্গে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া, অন্য স্কুলে ঢুঁ মারা, আর বন্ধু-বান্ধবীকে সঙ্গে নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরনোর জন্য বাড়ির অনুমতি পাওয়া। তবে ভিন্ন ভাষাভাষির শহর খড়্গপুরে সরস্বতী পুজো নিয়ে সেই উন্মাদনা অন্যান্য এলাকার থেকে বেশ কিছুটা কমই। তাই বছর কুড়ি আগে যখন দেশ জুড়ে শুরু হয়েছিল ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ নিয়ে উন্মাদনা, তখন সেই রেশ থেকে বাদ যায়নি রেলশহর। তা বজায় রয়েছে আজও।

রোমান ইতিহাসে কথিত তৃতীয় শতাব্দীর কথা। রোমের সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস নিদান দেন, ভাল সৈনিক তাঁরাই হতে পারে যাঁরা অবিবাহিত। তাই যুবকদের বিয়ে নিষিদ্ধ করেন তিনি। সম্রাটের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে সেন্ট ভ্যালেন্টাইন লুকিয়ে প্রেমিক-প্রেমিকাদের বিয়ের ব্যবস্থা করতে শুরু করেন। এমন ঘটনা জানতে পেরে সেন্টের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন সম্রাট। তারপর থেকেই শুরু হয় ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন। সেই রীতি ভারতে আসে নব্বইয়ের দশকে। আর তার ঢেউ রেলশহরে আসে বছর কুড়ি আগে। রেলের যান্ত্রিকতার সঙ্গেই দিন গুজরান হয় খড়্গপুরের বাসিন্দাদের। তাই প্রেমের জন্য এমন সবুজ একটা দিনের জন্য কার না সাধ জাগে? তাই যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শহরের নবীন প্রজন্মও মেতেছে ভালবাসার উৎসব পালনে। কিন্তু যখন ভালবাসার জন্য আলাদা দিন ছিল না, তখন কী ভাবে ভালবাসার দিনগুলো কাটাতেন শহরের প্রবীণরা? সেই গল্প শোনা গেল শহরের এক বাসিন্দার মুখে।

সালটা ১৯৯২। শহরের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষিকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ক্যাটরিন ভর্মার সঙ্গে আলাপ হয় শহরের আইনজীবী চন্দন গুহর। চার বছর প্রেমের পরে ১৯৯৬ দু’জন সাত পাকে বাঁধা পড়েন। ১৮ বছর বিবাহিত জীবনে এসেছে দুই সন্তান। আর বিয়ের পর ক্যাটরিনা এখন নাম বদলে গায়ত্রী গুহ। স্ম্ৃতি হাতড়ে বছর বিয়াল্লিশের গায়ত্রীদেবী বলেন, “আমার প্রেমের সময় এত কিছু ছিল না। আগে যে কোনও দিন ওর থেকে ফুলের তোড়া পেতাম। তাই এখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ওর থেকে ফুল পেলে খারাপ লাগে না।” পাশে দাঁড়িয়ে থাকা চন্দনবাবুও বলে ওঠেন, “ওঁর মধ্যে বরাবর এই দিনটি নিয়ে একটা উন্মাদনা ছিল। পরে আমিও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। একটা দিন একটু অন্য ভাবে ভালবাসার দিন পালন করলে ক্ষতি কী?” তাঁরাই জানান, সেই সময়ে খড়্গপুরে পার্ক বা রেস্তোরাঁ সে ভাবে ছিল না। ফলে নির্জনতা খুঁজে নিতে ভরা রাস্তায়। কখনও কখনও পাশাপাশি হেঁটে যাওয়াটাই অনেক মনে হত।

সেই সময়ের পর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। শহর কিন্তু ভালবাসার নতুন কোনও ঠিকানা পায়নি। আগে শহরের বাসিন্দাদের ঘোরার জায়গা ছিল হিজলি জঙ্গলের পাশের এলাকা। এমনকী ওই এলাকা স্থানীয়ভাবে প্রেমবাজার নামেই পরিচিত ছিল। আর এখনও সেই প্রেমবাজারেই ভিড় জমান নতুন প্রজন্ম। জমির অভাব দেখিয়ে হাল ছেড়েছে পুরসভা। বছর দশেক হল একটি পার্ক পেয়েছে শহরবাসী। তবে সেটিও শহরের থেকে বেশ কিছুটা দূরে হিজলি জঙ্গলের পঞ্চায়েত এলাকায়। প্রেমবাজারের সেই ইকো পার্কেই এখন ভালবাসার এই দিনটিতে জমে ওঠে ভিড়। আর তা না হলে রাস্তাঘাটে বাইকে ঘুরে বেড়ানো আর নিউ সেটলমেন্টের একমাত্র শপিং মল সম্বল তরুণ-তরুণীদের। তালবাগিচার বাসিন্দা ইংরেজি সাম্মানিকের কলেজ পড়ুয়া জয়শ্রী চৌধুরীর কথায়, “এমন দিন কাটানোর জন্য উপযুক্ত কোনও জায়গা নেই। হিজলির একটি মাত্র পার্কে ওই দিনে এত ভিড় হয় যে কিছুক্ষণ বসাই দায়।”

অন্যত্র যাই হোক না কেন, শহরের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে আইআইটি-তে ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালনের উদ্দীপনা একটু আলাদা। আইআইটি সূত্রে খবর, শহরের এখানেই প্রথম ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালন করা হত। তখনও ১৪ ফেব্রুয়ারি এলেই আইআইটি-র টেক মার্কেটে কেনাকাটায় ভিড় জমাতেন পড়ুয়ারা। এখনও একই নিয়মে ভ্যালেন্টাইন্স ডে-র দিনে স্কলার্স অ্যাভিনিউয়ে ভিড় জমান টেকনো-জুটিরা। প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর ধরে থাকা বি টেক ডুয়াল ডিগ্রির ইলেক্ট্রিক্যালের ছাত্র রাজারহাটের রণজয় মণ্ডলের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে একই বর্ষের বায়ো-টেকনোলজির ছাত্রী দমদমের পায়েল মণ্ডলের। তাঁদের কথায়, “কলকাতায় কোচিংয়ে দু’জনে দু’জনের নাম জানতাম। আইআইটিতে এসে প্রেম। প্রতি বছর নতুন করে ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ পালনের চেষ্টায় থাকি।” শহরের প্রবীণ সাহিত্যিক নন্দদুলাল রায়চৌধুরী অবশ্য ভালবাসার জন্য আলাদা একটা দিনের বিষয়ে সম্মত নন। তাঁর কথায়, “ভালবাসার জন্য নির্দিষ্ট কোনও দিন হয় বলে আমার মনে হয় না। সবটাই শরীরী আকর্ষণ আর ভ্যালেন্টাইন্স ডে হল মোহ। তাই তো এখন ভ্যালেন্টাইন্স ডে পালনের পরেই বিচ্ছেদও হচ্ছে। আবার তারপরই নতুন এটা সম্পর্ক। আমাদের যৌবনে এ সব ছিল না।”

তবে ভালবাসার বিশেষ দিনের যে ভাল চাহিদা রয়েছে, তা টের পাওয়া গেল স্থানীয় বাজারেও। ভালোবাসার বিশেষ দিনের উপহারে এসেছে বদল। আগে শুধু কার্ড, টেডিবিয়ার, পারফিউম, ডাচ গোলাপেই মন ভরে যেত প্রেমিক যুগলের। এখন বাজার মাতাচ্ছে লাল ঘেঁষা সফট্ টেডি, ক্যান্ডি, শো-পিস্, জুয়েলারি। আর ছেলেদের জন্য উপহার বলতে হাত ঘড়ি, মোবাইল, আইপড, ক্যামেরা। শহরের গোলবাজারে তিরিশ বছর কার্ড-উপহারের ব্যবসা করছেন পরেশ সোমানি (জৈন)। তাঁর কথায়, “প্রতি বছরই ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের চাহিদা থাকে। তবে এটুকু বলতে পারি, প্রতি বছরই চাহিদা বাড়ছে।”

ছবি: রামপ্রসাদ সাউ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE