Advertisement
E-Paper

প্লাস্টিক পাখায় কদর কমছে তালপাতার

হারিয়ে যাচ্ছে তালপাতার পাখার সেই মিষ্টি হাওয়া। পরিবর্তে বাজার দখল করছে রকমারি প্লাস্টিকের পাখা। কয়েক বছর আগেও গরমের সময় এক লক্ষের বেশি তালপাতার পাখা তৈরি করে জোগান দিতেন মাদল মণ্ডল।

আনন্দ মণ্ডল

শেষ আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০১৪ ০১:১৯
চলছে তালপাতার পাখা তৈরি।—নিজস্ব চিত্র।

চলছে তালপাতার পাখা তৈরি।—নিজস্ব চিত্র।

হারিয়ে যাচ্ছে তালপাতার পাখার সেই মিষ্টি হাওয়া। পরিবর্তে বাজার দখল করছে রকমারি প্লাস্টিকের পাখা।

কয়েক বছর আগেও গরমের সময় এক লক্ষের বেশি তালপাতার পাখা তৈরি করে জোগান দিতেন মাদল মণ্ডল। কিন্তু মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে সেই তালপাতার পাখার বাজার অনেকটাই দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিকের পাখা। হাল্কা অথচ দামে কম প্লাস্টিক পাখার চাহিদা বেশি। তাই সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে তালপাতার পাখার সাথে মাদলবাবুও তৈরি করছেন প্লাস্টিক পাখা। মাদলবাবুর দাবি, গরমে বাড়িতে আসা অতিথি আপ্যায়ন, মন্দিরে দেব-দেবীর জন্য কারুকার্যময় রাজপাখা তৈরির জন্য তালপাতার পাখার কদর আজও অম্লান।

তমলুকের রঘুনাথপুর ১ গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার পাকুড়িয়া গ্রামে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ করেন মাদল মণ্ডল ও নন্দলাল মণ্ডলের পরিবার। ওই দুই পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও পাখা তৈরির কাজে যুক্ত এলাকার প্রায় ৭০ জন কারিগর। বছরের অন্য সময়ের তুলনায় গরমে পাখার চাহিদা বাড়ে। তাই বাড়তি চাহিদা সামাল দিতে আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু করেন তাঁরা। শুকনো তালপাতা জলে ভিজিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে তা থেকে পাখা তৈরির জন্য ধাপে ধাপে বিভিন্ন কাজ করতে হয়। আর মাদলবাবু ও নন্দলালবাবুর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সেই কাজে হাত লাগান পাড়ার আরও কিছু পরিবারের গৃহবধূ ও ছোট ছেলে-মেয়েরা।

পৌষ মাসে যখন শীতের কামড়ে সবাই জবুথবু। সেই সময় থেকেই তালপাতার পাখা তৈরির কাজ শুরু করা হয়। পাখা তৈরির কাজ চলে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত। তালপাতা ছাড়াও ঝাঁটাকাটি, বার্ণিস পেপার (রঙিন কাগজ), সুতোর ফুল ও সুতো দিয়েও তৈরি করা হয় হাত পাখা। দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে তালপাতার পাখা তৈরির কাজে যুক্ত নন্দলালবাবু। তিনি বলেন, “আগের চেয়ে তালপাতার পাখার চাহিদা কমেছে। তার প্রধান কারণ তালপাতার পাখার বিকল্প হিসেবে বাজারে কম দামের প্লাস্টিকের (সানপ্যাকের) পাখা এসে গিয়েছে। প্লাস্টিকের পাখা হাল্কা, শৌখিন আবার দামও কিছুটা কম। ফলে ওই পাখা এখন বাজারে বিক্রি হচ্ছে।” নন্দলালবাবু জানান, কয়েকবছর আগেও আমি প্রতি গ্রীষ্মের মরসুমে এক লাখের বেশি পাখা তৈরি করতাম। এখন তা কমিয়ে ৫০ হাজার করেছি।

তালপাতার পাখার চাহিদা কমে যাওয়ায় প্লাস্টিক পাখা তৈরির কাজ করছেন ওই পাড়ারই আরেক পাখার কারিগর মাদল মণ্ডলের পরিবার। মাদলবাবু ছাড়াও তাঁর ভাই কমলবাবু ও পরিমলবাবু একসঙ্গে তালপাতার পাখা তৈরির কাজ করেন। বছর পঞ্চাশের মাদলবাবুও প্রায় ৪০ বছর পাখা তৈরির কাজ করছেন। মাদলবাবু বলেন, “যুগের হাওয়ায় তাল মিলিয়ে চলা ছাড়া উপায় নেই। লোহা, কাঁসা, পিতলের গৃহস্থালির সামগ্রীর বদলে যেমন স্টেনলেস স্টিল, প্লাস্টিকের বিভিন্ন জিনিসের চল এসেছে। একইভাবে, তালপাতার পাখার জায়গা দখলল করেছে প্লাস্টিকের পাখা। ইচ্ছে না থাকলেও পেশার তাগিদে আমাদের ওই প্লাস্টিকের পাখাও বানাতে হচ্ছে।” তিনি জানান, তালপাতার পাখার চাহিদা আগের চেয়ে অনেকটাই কমেছে। আগে প্রতি বছর গরমের মরসুমে প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার তালপাতার পাখা তৈরি করতাম। এখন সেটা কমিয়ে ৫০ হাজার করেছি। বাকিটা প্লাস্টিকের পাখা তৈরি করছি। প্লাস্টিকের পাখা যেমন হাল্কা তেমন আবার দামেও কম। তালপাতার পাখার যেখানে ৫ থেকে ৮ টাকা দাম। সেখানে ৩ থেকে ৬ টাকা দামেই প্লাস্টিকের পাখা পাওয়া যায়। এছাড়াও এইসব প্লাস্টিকের পাখায় বিভিন্ন রকমের ফুল ছাড়াও দেব, কোয়েল, শাহরুখের মত সিনেমার নায়ক-নায়িকা, সচিন, সৌরভের মতো খেলোয়াড়দের ছবি থাকে। ফলে আধুনিক হিসেবেও এই পাখার চল আছে। অর্ডার অনুযায়ী এইসব প্লাস্টিকের পাখা তৈরি করে দেওয়া হয়।

ভোটের মরসুমে কি পাখার চাহিদা অন্যবারের তুলনায় বেড়েছে?

মাদলবাবু জানান, এবার ভোটের প্রচারের জন্য তৃণমূলের প্রতীক আঁকা ১ লক্ষ প্লাস্টিক পাখা তৈরির জন্য এলাকার এক তৃণমূল নেতা অর্ডার দিতে এসেছিলেন। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে ওই পাখার জোগান দিতে পারব না বলে তা বাতিল করতে হয়েছে। তবে এবার অন্য ছবি আঁকা প্লাস্টিকের পাখার চাহিদাও আছে। তবে প্লাস্টিকের পাখার রমরমার বাজারে নাভিশ্বাস উঠছে তালপাতার পাখার। মাদলবাবু জানান, কয়েক বছর আগেও আমাদের গ্রামের ৫-৬টি পরিবার তালপাতার পাখা তৈরির কাজ ও ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। কারিগর হিসেবে দেড়শোর বেশি গ্রামবাসী এই কাজ করত। কিন্তু তালপাতার পাখার চাহিদা কমে যাওয়ায় অনেকেই পাখা তৈরির কাজ ছেড়ে দিয়েছে। বাকি পরিবার অন্য বিভিন্ন পেশায় চলে গিয়েছে।

মাদলবাবুর ভাই পরিমলবাবু বলেন, “প্লাস্টিকের পাখার চেয়ে দামে একটু বেশি হলেও তালপাতার পাখা অনেক বেশি টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব। তা ছাড়া তালপাতার পাখার হাওয়া অনেক আরামদায়ক। তাই এই পাখার চাহিদা সাময়িকভাবে কমলেও আবার তালপাতার পাখার চাহিদা বাড়বে বলেই আমাদের আশা।” পরিমলবাবু জানান, শুধু হাত পাখা নয়, আমরা বিভিন্ন মন্দিরের দেব-দেবীর জন্য রাজপাখাও তৈরি করি। বড় তালপাতা দিয়ে তৈরি কারুকার্যময় একটি রাজপাখার দাম আড়াইশো থেকে তিনশো টাকা। এছাড়াও বিয়ের জন্য, প্রিয়জনদের উপহার দেওয়ার জন্য তালপাতার পাখায় পুঁতির কাজ করা স্পেশাল পাখাও তৈরি করা হয়।

তবে দক্ষ কারিগর তৈরি না হলে তালপাতার এমন দৃষ্টিদন্দন পাখা যে জাদুঘরে ঠাই পাবে, এই কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে পাকুড়িয়া গ্রামে।

palm-leaf fan plastic fan ananda mondal tamluk
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy