Advertisement
১১ মে ২০২৪

পর্যটক কই, মৃতপ্রায় শঙ্করপুর

বেচাকেনা কেমন? প্রশ্নটা শুনেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন শঙ্করপুরের চা দোকানি বানেশ্বর পণ্ডা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, “সৈকতটা তো শ্মশান হয়ে গিয়েছে। কড়ি খসিয়ে কেন আসতে যাবেন পর্যটকেরা!” শঙ্করপুরে দাঁড়িয়ে দেখা গেল সেই ‘শ্মশান’-এর প্রমাণ। কেমন? শঙ্করপুরের গোটা সাতেক হোটেল-লজে অন্তত দেড় হাজার জনের থাকার বন্দোবস্ত রয়েছে। হোটেলগুলির দাবি, কয়েক মাস ধরে সব ক’টি হোটেল-লজ মিলিয়ে সাকুল্যে রয়েছেন জনা পঞ্চাশেক!

ভাঙনের কবলে শঙ্করপুর সৈকতে নামার রাস্তা। ছবি: সোহম গুহ

ভাঙনের কবলে শঙ্করপুর সৈকতে নামার রাস্তা। ছবি: সোহম গুহ

সুব্রত গুহ
শঙ্করপুর শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০০:৩৬
Share: Save:

বেচাকেনা কেমন? প্রশ্নটা শুনেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন শঙ্করপুরের চা দোকানি বানেশ্বর পণ্ডা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললেন, “সৈকতটা তো শ্মশান হয়ে গিয়েছে। কড়ি খসিয়ে কেন আসতে যাবেন পর্যটকেরা!”

শঙ্করপুরে দাঁড়িয়ে দেখা গেল সেই ‘শ্মশান’-এর প্রমাণ। কেমন? শঙ্করপুরের গোটা সাতেক হোটেল-লজে অন্তত দেড় হাজার জনের থাকার বন্দোবস্ত রয়েছে। হোটেলগুলির দাবি, কয়েক মাস ধরে সব ক’টি হোটেল-লজ মিলিয়ে সাকুল্যে রয়েছেন জনা পঞ্চাশেক! শিয়রে পুজো। তার আগে তেমন কোনও বুকিংও নেই, এমনটাই বলছেন হোটেল কর্তারা।

পূর্ব মেদিনীপুরের একদা জনপ্রিয় সৈকত পর্যটনকেন্দ্র শঙ্করপুরের এখন এমনই ‘দুয়োরানি হাল’। বাঁকুড়া থেকে শঙ্করপুরে বেড়াতে এসেছেন অশ্বিনী নন্দী। তাঁর কথায়, “আগেও এসেছি। কিন্তু, দিন দিন কেমন যেন মরে যাচ্ছে শঙ্করপুর।”

দিকজোড়া সোনালি সমুদ্র সৈকত, বিস্তীর্ণ বালুয়াড়ি-সহ ঝাউবন আর বালুকাবেলায় আছড়ে পড়া সফেন নীল জলরাশির মধ্যে জেলেদের মাছ ধরতে যাওয়া এমন সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে এক সময়ে বহু পর্যটকের গন্তব্য ছিল শঙ্করপুর। মন্দারমণি, তাজপুর সৈকত পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার অনেক আগেই দিঘা সংলগ্ন শঙ্করপুরের কদর ছিল তাঁদের কাছে। তা থেকে মাথা তোলে বেসরকারি হোটেল-লজ। রাজ্য মৎস্য দফতরের উদ্যোগে শঙ্করপুরে রাজ্যের প্রথম মৎস্যবন্দর তৈরি হয়। ‘পশ্চিমবঙ্গ মৎস্য উন্নয়ন নিগম’ ও ‘বেনফিশ’-এর উদ্যোগে তৈরি হয় অতিথিশালা (এখন লিজে রয়েছে)।

সেই সোনালি সময় এখন অতীত। অভিযোগ, আগে যত পর্যটক শঙ্করপুরে আসতেন এখন তার পঁচাত্তর শতাংশই মুখ ফিরিয়েছেন (তথ্য: দিঘা শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশ)। কেন? পর্যটকদের মতে ক্ষয়িষ্ণু সৈতকের পাশাপাশি এর প্রধানতম কারণ শঙ্করপুর অবধি সরাসরি গণ-পরিবহণ না থাকা। স্থানীয় সূত্রে খবর, দিঘা-কলকাতা সড়কের রামনগরের আগে চোদ্দ মাইলে নেমে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে শঙ্করপুর যেতে হয়। ওই চার কিলোমিটার যেতে ভরসা ইঞ্জিন রিকশা, আর রামনগর থেকে আসা গুটি কয়েক ট্রেকার। ফলে যাঁরা নিজস্ব গাড়িতে শঙ্করপুর আসতে পারেন না তাঁদের ভরসা ওই রিকশা কিংবা ট্রেকারই। নৈহাটি থেকে শঙ্করপুর এসেছেন চিন্ময় মোদক এবং তাঁর স্ত্রী অঞ্জলি মোদক। তাঁদের বক্তব্য, পর্যটক দেখলেই ইঞ্জিন রিকশাগুলি কয়েক গুণ বেশি ভাড়া চায়। একে পর্যটন-সঙ্কট, তাঁর উপরে এ ভাবে বহু পর্যটক আসতে না পারায় বর্তমানে ধুঁকছে শঙ্করপুর।

স্থানীয় প্রাক্তন সিপিএম বিধায়ক স্বদেশরঞ্জন নায়কের মতে, বাম আমলে শুরু হওয়া শঙ্করপুরে বাসস্ট্যান্ডের কাজ শেষ না হওয়ার ফলেই এমন অবস্থা। স্থানীয় সূত্রে খবর, পর্যটন এবং মৎস্যবন্দরের স্বার্থে বাম আমলে সরকারি বাসগুলি কলকাতা-দিঘা যাতায়াতের সময়ে শঙ্করপুর ছুঁয়ে গেলেও, এখন আর শঙ্করপুর মুখো হয় না। এমনকী, হাওড়া-শঙ্করপুর রুটের দু’টি বেসরকারি বাসও শঙ্করপুর না ঢুকে রামনগর পর্যন্ত যাতায়াত করে। কেন? বাস মালিকরা বলছেন, “পর্যটক কই? খালি গাড়ি নিয়ে তো আর শঙ্করপুর অবধি যাওয়া যায় না!”

আরও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে পর্যটকদের। তাঁদের বক্তব্য, দীর্ঘ কয়েক বছরের সমুদ্র পারের ভাঙনে বিপুল ক্ষতি হয়েছে এই পর্যটনকেন্দ্রের। ভাঙন রুখতে কাঠের খাঁচা তৈরি করে তাতে বোল্ডার, পাথর ঢুকিয়ে ‘জিও টিউব’ প্রকল্প নেয় দিঘা শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ। কিন্তু, জলোচ্ছ্বাস ঠেকানো তো দূর, কয়েক কোটি টাকা ব্যয়ে ওই প্রকল্প জলোচ্ছ্বাসেই ভেসে গিয়েছে। আগে সৈকত-স্নানে নামার জন্য দু’টি ঘাট থাকলেও বোল্ডার আর পাথরের ভিড়ে সে দু’টিই হারিয়ে গিয়েছে। সৈকতে ছোট দোকান রয়েছে রবি দাসের। তাঁর মন্তব্য, “পর্যটকবাবুরা বেড়াতে এসে সৈকতে নামতে পারবেন না, সমুদ্র স্নান করতে পারবেন না, তা হলে কীসের টানে আসবেন তাঁরা?”

শঙ্করপুরের এমন হাল কবুল করে দিঘা শঙ্করপুর হোটেলিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (ডিএসএইচএ)-এর সহ-সভাপতি বিজয়লক্ষ্মী কুণ্ডু বলেন, “দিঘার হোটেলে পর্যটকদের ঘর দিতে হিমসিম। সেখানে শঙ্করপুরে তাঁদের দেখা মেলাই ভার! কালে-ভদ্রে দু’একজন এলেও কোনও মতে একটা দিন বা রাত কাটিয়েই অন্যত্র চলে যান। জানাতে ভোলেন না, শঙ্করপুরে এসে ভুল করেছেন!”

মূল সমস্যা যেখানে, সেই বাসস্ট্যান্ড তৈরি হয়নি কেন? দিঘা শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদ (ডিএসডিএ)-এর নির্বাহী আধিকারিক সুজন দত্ত বলেন, “নতুন এসেছি। শঙ্করপুরে বাসস্ট্যান্ডের শিলান্যাসের পরে কাজ শুরু হয়েছিল এমন তথ্য জানা নেই।” পর্ষদের তরফে বাসস্ট্যান্ড তৈরির কোনও পরিকল্পনা নেই, এমনটাও জানিয়েছেন সুজনবাবু।

শঙ্করপুরের সাতটি হোটেলের মধ্যে সৈকতের কাছেই রয়েছে পাঁচটি হোটেল। সেগুলিতে যাওয়ার একমাত্র রাস্তাটি এখনও বর্ষার সময়ে জল-কাদায় কদাকার হয়ে থাকে। হোটেলগুলির অভিযোগ, দিন দিন নানা রকমের করের বোঝা চাপছে। কিন্তু পরিষেবায় ন্যূনতম নজর নেই প্রশাসন কিংবা ডিএসডিএ-র। প্রাক্তন বাম বিধায়ক বলছেন, “পর্যটনকেন্দ্রের উন্নয়নের নামে দিঘায় কোটি কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে। তার সিকিভাগও শঙ্করপুরের জন্য খরচ হলে, এই পর্যটনকেন্দ্রের চেহারা বদলে যেত।”

শঙ্করপুরের এমন অবস্থায় ক্ষুব্ধ ডিএসএইচএ-এর সভাপতি অনাদি দাসও। তাঁর তোপ, “মুখ্যমন্ত্রী তো দিঘাকে গোয়া বানাতেই ব্যস্ত। সকলের নজর রয়েছে মন্দারমণি কিংবা তাজপুরের দিকেও। কিন্তু, শঙ্করপুরের উন্নয়ন তো দূর, যা ছিল তা-ও ধ্বংসের এখন মুখে।”

সব মিলিয়ে, সরকারি অবহেলা আর উদাসীনতায় পর্যটকেরা মুখ ফেরাচ্ছেন দুয়োরানি শঙ্করপুর থেকে। কবে এর বদল হয়, দেখার সেটাই!

সঙ্কটের পাঁচ-কাহন

• সমুদ্র-স্নানের জায়গার অভাব

• দীর্ঘ কয়েক বছরের সমুদ্র ভাঙন

• নেই সরাসরি গণ-পরিবহণ, বাস স্ট্যান্ড

• নির্জন এলাকায় নিরাপত্তার ঝুঁকি

• পর্ষদের গা-ছাড়া মনোভাব

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

subrata guha shankarpur tourist spot
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE