লোধাশুলিতে রাহুল সিংহ। ছবি: দেবরাজ ঘোষ।
লোকসভা ভোটে তৃণমূলের বিপুল সাফল্যের পর রাতারাতি যেন বদলে গিয়েছে ছবিটা! সারা রাজ্যের মতোই জঙ্গলমহল জুড়েও যেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভের চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে। তাই লোকসভা ভোটের পরে রবিবার প্রথম বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের জঙ্গলমহল সফরে তাঁকে ঘিরে উৎসাহীদের ভিড় জমল ভালই। আর তাই দেখে চওড়া হেসে রাহুলবাবু জানিয়ে দিলেন, আগামী দিনে আরও উল্লেখযোগ্য ইন্দ্রপতন ঘটতে চলেছে বাম ও তৃণমূল শিবিরে।
রবিবার জঙ্গলমহলের তিনটি জায়গায় সভা করেন রাহুলবাবু। প্রথম সভাটি ছিল ঝাড়গ্রামের লোধাশুলিতে। এরপর গোপীবল্লভপুর বাজার এবং সবশেষে নয়াগ্রামের মলম অঞ্চলের ভালিয়াচাটি গ্রামের মাঠে সভা করেন রাহুলবাবু। প্রতিটি সভায় ছিল উপচে পড়া ভিড়। তবে নয়াগ্রামের সভায় সবচেয়ে বেশি ভিড় হয়েছিল। রাহুলবাবুর হিসেবে জঙ্গলমহলে এ দিন সিপিএম, সিপিআই, তৃণমূল ও আঞ্চলিক ঝাড়খণ্ডী দল ছেড়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার কর্মী-সমর্থক বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিজেপির রাজ্য সভাপতির দাবি, তিনটি সভা ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের আগে ‘নবীন বরণ’ অনুষ্ঠান।
এ দিন সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ঝাড়গ্রামের লোধাশুলি মোড়ে ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের ধারে প্রথম সভাটি করেন রাহুলবাবু। রাহুলবাবুর হাতে স্মারকলিপি তুলে দেন কাজ হারানো ১৭৯ জন সিভিক পুলিশ। মাওবাদী হানায় নিহত বেশ কয়েকজনের পরিজনরাও সরকারি ক্ষতিপূরণ না পাওয়ার অভিযোগ জানান। সভায় হাজির ছিলেন বিনপুরের শিলাদিত্য চৌধুরী। বেলপাহাড়ির সভায় সারের দাম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করায় শিলাদিত্যকে মাওবাদী তকমা দিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছিল। লোধাশুলির সভায় লালগড়ের ঝাড়খণ্ড পার্টির নেতা বুদ্ধেশ্বর মাহাতো যোগ দেন। বুদ্ধেশ্বরবাবুর কথায়, “আমরাই মমতার সভায় লোক জুটিয়েছিলাম। শাসক দলের নেতাদের অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় এখন আমাদের সপরিবারে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হচ্ছে।” ঝাড়গ্রাম শহর-সহ জামবনি, বিনপুর, ঝাড়গ্রাম, সাঁকরাইল ব্লকের সিপিএম, সিপিআই, ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা ও ঝাড়খণ্ড পার্টির কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থক বিজেপিতে যোগ দেন।
এরপর গোপীবল্লভপুর বাজারে সভা করেন রাহুলবাবু। সেখানে কেন্দুগাড়ি গ্রাম পঞ্চায়েতের ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার উপ-প্রধান ব্রজমোহন মুর্মুর নেতৃত্বে ৬ জন পঞ্চায়েত সদস্য বিজেপিতে যোগ দেন। গোপীবল্লভপুর-১ পঞ্চায়েত সমিতির ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার সদস্য নগেন সিংহ, শাসড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম সদস্য রবীন বিশুই এবং গোপীবল্লভপুর ২ ব্লক তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি সুকুমার বাগ বিজেপিতে যোগ দেন। নয়াগ্রামের সভায় নয়াগ্রাম ব্লকের সিপিএমের ক্ষমতাসীন মলম গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান-সহ ৬ জন সদস্যও বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন। বিজেপি’র ঝাড়গ্রাম জেলা সাধারণ সম্পাদক অবনী ঘোষের দাবি, সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যের নিরিখে ওই তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েতই এখন বিজেপির দখলে চলে এল। সবশেষে বিকালে নয়াগ্রামের ভালিয়াচাটি গ্রামের মাঠে সভা করেন রাহুলবাবু। সেখানে মলম গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান পার্বতী মুর্মু-সহ ৬ জন পঞ্চায়েত সদস্য বিজেপিতে যোগ দেন। এ ছাড়াও লখিন্দর নায়েক, নরেন শিট, স্বদেশরঞ্জন কুইলার মতো নয়াগ্রামের বেশ কয়েক জন সিপিএম নেতা বিজেপিতে যোগ দেন। তৃণমূলের চাঁদাবিলা অঞ্চলের নেতা মহেন্দ্র মাহাতোও এ দিন অনুগামীদের নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেন।
জঙ্গলমহলে এসে মাওবাদী প্রসঙ্গে রীতিমতো আক্রমণাত্মক রাহুলবাবু এ দিন তিনটি সভাতেই বলেন, “জঙ্গলমহলে আগে মাওবাদীরা খুন-সন্ত্রাস করে জঙ্গলে লুকিয়ে যেত। আর এখন সরকারি মাওবাদীরা মানুষের ঘরে হামলা চালিয়ে থানায় বসে চা খাচ্ছে। সরকার বলছে ওরা নাকি জঙ্গলমহলকে মাওবাদী মুক্ত করে দিয়েছে। মাওবাদী মুক্ত করবে কী? মাওবাদী তো ওরা নিজেই।” শিল্প প্রসঙ্গে তৃণমূলের সরকারকে তুলোধনা করেছেন রাহুলবাবু। তাঁর কথায়, “রাজ্যের উন্নয়নের জন্য ২০১৬ সালে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে। এই অপদার্থ সরকারকে ফেলে দিয়ে বিজেপির সরকারকে রাজ্যের ক্ষমতায় আনতে হবে।”
ক্ষমতায় আসার তিন বছরের মধ্যেই জঙ্গলমহলে রাজনৈতিক ভাবে নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখার প্রমাণ দিয়েছিল তৃণমূল। গত বছর পঞ্চায়েত ভোটে জঙ্গলমহলের সিংহভাগ পঞ্চায়েত সমিতি ও গ্রাম পঞ্চায়েত তৃণমূল দখল করে নেয়। পুরভোটেও তিন দশকের বাম পুরসভাটি তৃণমূল নিরঙ্কুশ ভাবে দখল করে নেয়। এবার লোকসভা ভোটে বৃত্ত সম্পূর্ণ করে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল। দীর্ঘদিন সিপিএমের দখলে থাকা ঝাড়গ্রাম লোকসভা কেন্দ্রটি এবার তৃণমূল পায়। কিন্তু জঙ্গলমহলে শাসক দলের বিরুদ্ধে গত তিন বছরে যে পরিমাণ ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা আঁচ করতে পারেন নি তৃণমূল নেতৃত্ব। বিজেপির সভায় ভড় প্রসঙ্গে তৃণমূলের জেলা সভাপতি দীনেন রায় অবশ্য বলেন, “ধূমকেতুর মতো অনেকেই আসে। চলেও যায়। আমাদের দলের কেউই বিজেপিতে যোগ দেয়নি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy