Advertisement
০৫ মে ২০২৪

মাল্টিপ্লেক্স নেই, জমে না গানের আসরও

সকলের গান থেকে স্মার্ট ফোনের মিউজিক অ্যাপস্। সিনেমা হলে অনেকে মিলে হুল্লোড় করে বায়োস্কোপ দেখার পরিবর্তে বাড়িতেই সিডি বা ডিভিডি এনে সিনেমা দেখে নেওয়া। না হলে ডাউনলোড করে। বিনোদনের পন্থা-পদ্ধতিই এখন বদলে গিয়েছে। বাড়িতে গানের রেওয়াজ বা মেজাজি আড্ডার চলও সময়ের সঙ্গে হারাতে বসেছে।

সিনেমা হল আর নেই। রিকশার রুটেই থেকে গিয়েছে মহুয়ার নাম।

সিনেমা হল আর নেই। রিকশার রুটেই থেকে গিয়েছে মহুয়ার নাম।

সুমন ঘোষ ও বরুণ দে
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৪ ০০:৪৯
Share: Save:

সকলের গান থেকে স্মার্ট ফোনের মিউজিক অ্যাপস্।

সিনেমা হলে অনেকে মিলে হুল্লোড় করে বায়োস্কোপ দেখার পরিবর্তে বাড়িতেই সিডি বা ডিভিডি এনে সিনেমা দেখে নেওয়া। না হলে ডাউনলোড করে।

বিনোদনের পন্থা-পদ্ধতিই এখন বদলে গিয়েছে। বাড়িতে গানের রেওয়াজ বা মেজাজি আড্ডার চলও সময়ের সঙ্গে হারাতে বসেছে।

উত্তরণের এই হাইওয়ে বেয়ে বদলে গিয়েছে মেদিনীপুরও। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আজ বিস্মৃতির অতলে শহরের বিনোদনের ইতিহাসও। শহরের বুকে পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ভীমসেন যোশী, উস্তাদ বিলায়েত খান, বিসমিল্লা খান, পণ্ডিত যশরাজ, উস্তাদ বড়ে গুলাম আলির সে সব সোনাঝরা অনুষ্ঠান আজ অতীত।

বছর দশ-পনেরো আগেও শহরে তিনটে সিনেমা হল ছিল। এখন সেখানে সাকুল্যে শহরে একটিই সিনেমা হল। মেদিনীপুরের যে মহুয়া, অরোরা সিনেমা হলের সামনে এক সময় রীতিমতো টিকিট ব্ল্যাক হতো, ভিড় জমাতেন শয়ে শয়ে মানুষ। সেসব হল ভেঙে গজিয়ে উঠছে বহুতল। তাই শহরের সিনেমাপ্রেমীদের এখন একমাত্র ঠিকানা হরি সিনেমা হল। মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম সদস্য সিদ্ধার্থ সাঁতরা বলছিলেন, “তখনকার শহর, আর এখনকার শহর, সত্যিই অনেক বদলে গিয়েছে। সেই সময়ও শহরে তিনটে সিনেমা হল ছিল। আর এখন মাত্র একটি। বন্ধ হয়ে যাওয়া দু’টি সিনেমা হলের সঙ্গে শহরের কত অতীত জড়িয়ে রয়েছে।”

শহরের বিধাননগর এলাকার পাশে ছিল মহুয়া সিনেমা হল। বসন্ত বিলাপ ছবির কিছুটা শু্যটিং এই শহরে হয়েছিল। সেই ছবিতেও ধরা রয়েছে মহুয়া সিনেমা। গোলকুয়াচকের কাছে ছিল অরোরা। মেদিনীপুর শহরে প্রথম গড়ে ওঠে এই অরোরা হলই। সত্তর-আশির দশকে সিনেমা দেখতে অরোরায় ভিড় জমত ভালই। পরে অবশ্য ছবিটা বদলে যায়। ভিড় বেশি হতে থাকে মহুয়াতে। কারণ, এই হলে ছিল আধুনিকতার ছোঁয়া। ১৯৬৩ সালে সংস্কৃতিমনস্ক কয়েকজন যুবকের উদ্যোগে গড়ে ওঠে মেদিনীপুর ফিল্ম সোসাইটি। সোসাইটির কার্যনির্বাহী সভাপতি শিবাংশু বসুর কথায়, “’৬৯-’৭০ সালে আমরা অরোরা সিনেমা হল ৬০ টাকায় ভাড়া করতাম। রবিবার সকালে শো হত। সোসাইটির সদস্য, তাঁদের পরিবারের সদস্যরা ছবি দেখতে আসতেন।” এখন শহরের একমাত্র হরি সিনেমা হলের কর্মী তাপস সাউয়ের আক্ষেপ, “এখন আর সিনেমা হলে এসে ছবি দেখার তেমন উচ্ছ্বাস নেই। ইন্টারনেট- ইউটিউবে ছবি মিলছে। অবৈধ ডিভিডির ব্যবসা চলছে। আমাদের হলে সাতশোরও বেশি আসন রয়েছে। প্রায় দিনই নামমাত্র লোক সিনেমা দেখতে আসেন।” এর পিছনে অবশ্য অন্য যুক্তিও রয়েছে। এখন যাঁরা সিনেমা পরিচালনা করছেন, তাঁদের অনেকের মতে, জেলার হলগুলোর আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। অনেক হলই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত নয়, হলে ফুড কোর্টও নেই। বাংলা ছবির ব্যবসা বাড়াতে হলে জেলার হলগুলোর সংস্কার প্রয়োজন। বন্ধ হলগুলোও খুলতে হবে। শহরে একটিমাত্র হলে সবসময় পছন্দের সিনেমা দেখার সুযোগ মেলে না। শহরের বাসিন্দা কলেজ পড়ুয়া রিঙ্কু কর, অভিষেক দাসেদের কথায়, “মেদিনীপুরের মতো শহরে এখন মাত্র একটাই সিনেমা হল, না আছে মাল্টিপ্লেক্স, না আছে আইনক্স। অনেক ছবি তো শহরের হলে আসেই না।”

সঙ্গীতশিল্পী চণ্ডীচরণ পাঠক ও জয়ন্ত সাহার আক্ষেপ,
শহরে সঙ্গীতানুরাগীর সংখ্যা কেবলই কমছে।

এক সময়, শহরে সঙ্গীত সম্মেলনে সঙ্গীত প্রেমীদের ভিড় উপচে পড়ত। টিকিট জোগাড় না করতে পারলে হলের বাইরে কাগজ পেতে বসে পড়তেন হাজারে হাজারে মানুষ। ১৯৫৮ সালে শহরে প্রথম শুরু হয় যদুভট্ট সম্মেলন। মেদিনীপুর শহরের বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী শচীন সাহার উদ্যোগেই এই সম্মেলন হত। কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীতের তাবড় শিল্পীরা হাজির থাকতেন ওই সম্মেলনে। তবলায় কাণ্ঠে মহারাজ, নাঙ্কু মহারাজ, সান্তা প্রসাদ, নৃত্যে রওশন বাঈ, বেহালায় ভি জি যোগ, খেয়ালে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, নাজাকত-সালামত, তারানায় নিসার হোসেন খান, রিনা রাও পট্টবর্ধণ থেকে শুরু করে সেতার-বেহালা-তবলার মতো যন্ত্রসঙ্গীতের পাশাপাশি কণ্ঠসঙ্গীতের একাধিক গুণী শিল্পীরা অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্র থেকে শুরু করে প্রায় সব শিল্পীরাই বারেবারে এসেছেন এই মেদিনীপুরে। পরবর্তী কালে মেদিনীপুর শহরে আহমেদ বক্স, সাধন পাঠক, লক্ষ্মী দাস, কওসর খাঁদের মতো প্রখ্যাত শিল্পী মিলে চালু করলেন তান সেন সঙ্গীত সমাজ। যাঁরা এই ধরনের বড় কয়েকটি অনুষ্ঠানও করেছিলেন। কিন্তু তা-ও বেশিদিন টেকেনি।

বর্তমানে কোথাও যেন তাতে ভাটা পড়েছে। তাহলে কী স্মৃতি হয়েই থেকে যাবে পুরনো এই ঐতিহ্য? শিল্পী থেকে শুরু করে বর্তমানের উদ্যোক্তাদের মতে, ক্ল্যাসিক্যাল সঙ্গীতের আসর করা কঠিন। অন্য গুণী শিল্পীদের নিয়েও অনুষ্ঠান করতে গেলে সমস্যা। কেন? তাঁদের কথায়, “স্পনসর মিলবে না। চটুল সিনেমার নায়ক-নায়িকারা এলে মাঠে হু হু করে মানুষের ঢল নামবে। কিন্তু সাধনাতে কেউ থাকবে না।” বেহালা বাদক গোপাল দাসের আক্ষেপ, “এখন মানুষ যন্ত্রসঙ্গীতের দিকে যাচ্ছেই না। দ্রুত গতিতে চটজলদি দু’টো গান শিখে নিয়ে স্কুলের অনুষ্ঠানে, পাড়ার পুজোয় গাইতে পারলেই খুশি। তাই কত কষ্ট করে বেহালা শিখেও এখন ছাত্র মেলে না। বেহালা শেখার কথা বললে, পাল্টা বলেন গান শেখান না। তবু আমি বেহালাকে ধরে রেখেছি।”

রিয়্যালিটি শো-এর যুগে শাস্ত্রীয় নৃত্যে আগ্রহী ছাত্রছাত্রী মেলাও ভার। কিছু চটুল হিন্দি গানের সঙ্গে নাচতে পারাটাই এখন বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তার সঙ্গে রয়েছে আধুনিক গানের তালে তাল মিলিয়ে নাচ। যার পোশাকি নাম, ‘ক্রিয়েটিভ ডান্স’। নৃত্যশিল্পী নবনীতা বসুর কথায়, “এখন হাতে গোনা দু’-চার জন ছাত্রছাত্রী ক্লাসিক্যালের উপর জোর দেয়। কোরিওগ্রাফি, ফিউসন, ক্রিয়েটিভ ডান্সের উপরেই সবার নজর বেশি।” নৃত্য শিল্পীদের মতে, এখন বেশিরভাগ বাবা-মা চান পাড়ার অনুষ্ঠানে নিজের মেয়ে নাচছে তা দেখতে। ছোটখাটো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করাতে। কিন্তু যে কোনও নাচের জন্যই যে শাস্ত্রীয় নৃত্য শেখা জরুরি, সেটা বুঝতে চান না অনেকে।

প্রতিযোগিতার দড়ি টানাটানিতে হারিয়ে যাচ্ছে ছবি আঁকার প্রাচীন ঘরানাও। ছেলে কিছু একটা এঁকে পুরষ্কার পেয়ে যাবে, তার জন্য যা করণীয় তা করতে হবে, বাবা-মায়েরা সেটাই চান। আঁকার ক্ষেত্রেও যে জল রঙ, তেল রঙের ব্যবহার, গ্লাস পেন্টিং— কত রকমের শেখার বিষয় রয়েছে তা বোঝার ধার ধারে না কেউ। শিক্ষক কল্যাণ করের কথায়, “এখন মূলত অঙ্কন শিক্ষাটা প্রতিযোগিতামুখী হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলে স্কুলে আর পাঁচজনের থেকে ভাল আঁকবে, পাড়ার প্রতিযোগিতায় পুরষ্কার পাবে, সেই লক্ষ্যেই আঁকার স্কুলে পাঠান বাবা মা। তাকে কেন্দ্র করে কেউ বড় হবে এই মানসিকতা এখন নজরেই পড়ে না।”

সত্যিই সময়ের সঙ্গে বদলায় মানসিকতা। শহর জুড়ে বাড়তে থাকে ভিড়। এক লাখ, দেড় লাখ ছাড়িয়ে শহরের জনসংখ্যা এখন প্রায় পৌনে দু’লাখ। তবু বেঁচে থাকে কত স্মৃতি। বাস্তবে না হলেও সেই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকে শহরের সাংস্কৃতিক গৌরব।

ছবি: সৌমেশ্বর মণ্ডল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

cenema hall sumana ghosh barun dey
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE