Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

মমতার ধমক খেয়ে কোমর বাঁধছে পুরসভা

দেখতে দেখতে মেদিনীপুর পুরসভার বয়স হয়ে গেল দেড়শো বছর। এতগুলি বছরে ডান-বাম সকলেই থেকেছে পুরসভার ক্ষমতায়। কিন্তু পুর নাগরিকেরা পুর পরিষেবায় কী আদৌ সন্তুষ্ট? প্রশ্নটা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তিনি কয়েক মাস আগে মেদিনীপুরে এসে বলেছিলেন, শহরে যানজট এড়াতে ফুটপাথ করতে হবে। এখনও তা তৈরি হয়নি! শুধু তা-ই নয়, ঐতিহ্যশালী ও প্রাচীন এই শহরে সৌন্দর্যেরও যে বড় অভাব।

ফুটপাথ নেই। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়েই চলে যাতায়াত।  নিজস্ব চিত্র

ফুটপাথ নেই। ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা দিয়েই চলে যাতায়াত। নিজস্ব চিত্র

সুমন ঘোষ
মেদিনীপুর শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:১৮
Share: Save:

দেখতে দেখতে মেদিনীপুর পুরসভার বয়স হয়ে গেল দেড়শো বছর। এতগুলি বছরে ডান-বাম সকলেই থেকেছে পুরসভার ক্ষমতায়। কিন্তু পুর নাগরিকেরা পুর পরিষেবায় কী আদৌ সন্তুষ্ট?

প্রশ্নটা যে অমূলক নয়, তার প্রমাণ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। তিনি কয়েক মাস আগে মেদিনীপুরে এসে বলেছিলেন, শহরে যানজট এড়াতে ফুটপাথ করতে হবে। এখনও তা তৈরি হয়নি! শুধু তা-ই নয়, ঐতিহ্যশালী ও প্রাচীন এই শহরে সৌন্দর্যেরও যে বড় অভাব। যা দৃষ্টি এড়ায়নি মুখ্যমন্ত্রীর। দু’টি সরকারি অনুষ্ঠান ও এবং দলীয় কর্মসূচিতে ফের এসেছিলেন তিনি। রবিবার রাতে নিজে শহর ঘুরে দেখেন।

শহরের হাল দেখে হতাশ হয়ে ডেকে পাঠান পুরপ্রধান প্রণব বসুকে। নির্দেশ দেন, অবিলম্বে শহরকে সুন্দর করে সাজাতে হবে। পুরপ্রধান জানান, ‘তা করতে হলে তো অর্থের প্রয়োজন।’ মুখ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন, ‘অর্থ সমস্যা হবে না। পরিকল্পনা তৈরি করুন।’ শহরের উন্নয়নে প্রয়োজনে তাঁকে ফোন করার কথাও জানিয়ে দেন। পুরপ্রধান প্রণব বসু বলেন, “মেদিনীপুর ঐতিহাসিক শহর। বহু ঐতিহ্য রয়েছে। তাই শহরকে সুন্দর করে সাজানোর উপরে জোর দিচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী।” কিন্তু প্রশ্ন হল, এত দিন তা হয়নি কেন? পুরপ্রধানের কথায়, “শহরকে সাজাতে বেশ কিছু বড় কাজ প্রয়োজন। কিন্তু, সেই পরিমাণ টাকা নেই। এ বার নতুন করে প্রকল্প তৈরি করে পাঠাব। টাকা পেলে কাজ হবে।”

পুরসভা টাকা পায় না, এমন নয়। রাজ্য অর্থ কমিশন ছাড়াও কেন্দ্রীয় বিভিন্ন প্রকল্প থেকেই পুরসভার উন্নয়নে টাকা মেলে। যেমন বস্তি উন্নয়ন, রাস্তা, পানীয় জল, আলো প্রভৃতি। তবু শহরে সমস্যার শেষ নেই। কেন? পুর কর্তৃপক্ষের মতে, যে খাতে টাকা আসে তাতেই সেই টাকা খরচ করতে হয়। তা হলে কেন পরিকল্পনা তৈরি করে টাকা আনানো যায়নি? বর্তমানে রাজ্য সরকার ও পুরসভা দু’টি ক্ষেত্রেই শাসক তো তৃণমূল! পুর কর্তৃপক্ষ বলছেন, কিছু কিছু পরিকল্পনা তৈরি করে দেওয়া রয়েছে। কিন্তু টাকা মেলেনি। মুখ্যমন্ত্রী আশ্বাস মেলায় ফের প্রকল্প তৈরি করে পাঠাচ্ছেন পুর কর্তৃপক্ষ।

কী কী সমস্যা রয়েছে শহরে? প্রথম এবং প্রধান সমস্যা হল হকার। রাস্তার দু’ধারে বেআইনি ভাবে গড়ে ওঠা দোকানের সংখ্যা প্রতিদিন বেড়েই চলেছে। তার জেরে শুধু রাস্তা সঙ্কুচিত হচ্ছে এমন নয়, সমস্যা দেখা দিচ্ছে নিকাশী ব্যবস্থারও। কারণ, নিকাশী নালার উপরেই রয়েছে দোকান। ফলে নালা পরিষ্কার করা যাচ্ছে না। আবর্জনা পড়ে বন্ধ হচ্ছে নালা। সামান্য বৃষ্টিতেই নালা ছাড়িয়ে জল যাচ্ছে রাস্তায়। ক্ষতি হচ্ছে রাস্তারও। বাড়ছে খানাখন্দ। সমস্যা রয়েছে আরও। শহরের প্রধান এলাকাগুলি, যেখানে বাস থামে, জনসমাগম বেশি, সেই মোড় বা চকে নেই কোনও শৌচালয়! কালেক্টরেট মোড় হোক বা এলআইসি চক, কেরানিতলা হোক বা গোলকুঁয়াচক। শৌচালয়ের নেই বাজারগুলিতেও।

এক সময় শৌচালয় ছিল না তা নয়। কালের নিয়মে কোথাও তা ভেঙেছে কোথাও বেদখল হয়েছে। নতুন করে তৈরির তেমন উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি। মেদিনীপুর-খড়্গপুর উন্নয়ন পর্ষদ দু’তিনটি জায়গায় শৌচালয় তৈরি করলেও তা তালাবন্ধ পড়ে! তাতে বিশেষত, মহিলাদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়।

আর একটি বড় সমস্যা রয়েছে নিকাশী নালা নিয়ে। শহরের বিস্তীর্ণ এলাকার জল নিকাশির জন্য একটি খাল রয়েছে। খালটি মজে কিছুটা বেআইনি দখলদারদের হাতে চলে গেলেও কিছুটা কাজ করে। শহরের উঁচু এলাকাটির, অর্থাৎ বিধাননগর, রবীন্দ্রনগর, বাসস্ট্যান্ড, বাজর্টাউন, নান্নুরচক, জজকোর্ট, পাটনাবাজার, স্কুলবাজার, বক্সীবাজার এলাকার জল সে দিকে যায়। কিন্তু নীচু অংশ অর্থাৎ রাজাবাজার, হাঁসপুকুর, হবিবপুর, কর্ণেলগোলা, কালিতেলিচক, বড় আস্তানা-সহ বেশ কয়েক’টি এলাকার জল এসে পড়ে ধর্মায়। আগে তা মাঠ থাকায় সমস্যা হত না। বর্তমানে ওই এলাকায় তৈরি হয়েছে বসতি। নিকাশি নালা না থাকায় সূর্যনগর, রামকৃৃষ্ণনগর, বিবেকানন্দপল্লি সহ নতুন নতুন এই এলাকাগুলি বর্ষায় জলমগ্ন হয়। এই জল নিকাশীর জন্য একটি বড় খালের প্রয়োজন। কিন্তু তা তৈরির কোনও উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

আবর্জনা ফেলার জায়গাটিও ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। ধর্মার একদিকে শহরের যাবতীয় আবর্জনা ফেলা হয়। শহরে ঢোকার আগেই যে কোনও মানুষকে দুর্গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দিয়ে ঢুকতে হয়। ওই বর্জ্যকে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে সার তৈরির পরিকল্পনার দাবি ছিল দীর্ঘ দিনের। এখনও যা বাস্তবায়িত হওয়া দূরের কথা, তেমন কোনও পদক্ষেপও লক্ষ্য করা যায়নি! কেন এত উদাসীনতা? কেনই বা উন্নয়নে এত অনীহা? কংগ্রেস কাউন্সিলর শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “পুর প্রশাসনকে যেমন সক্রিয় হতে হবে, তেমনি কাউন্সিলরদেরও উদ্যোগী হতে হবে।”

শহরের উন্নয়ন থমকে থাকার কারনে প্রধান কারণগুলি কী কী? পুরসভা সূত্রে জানা গিয়েছে, মূল সমস্যা সময়ে কাজ না করতে পারা। ফলে পরের কিস্তির টাকা পেতে সমস্যা হয়। জমি সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে বিবাদ মিটিয়ে কাজ সম্পূর্ণ করতে দীর্ঘ সময় লাগে।

মুখ্যমন্ত্রীর চাপে এ বার কী কিছুটা তৎপর হবে পুর কর্তৃপক্ষ? সত্যিই শহরের উন্নয়ন হবে, সেজে উঠবে শহর? তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়? কারণ, এক সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণে স্বয়ংক্রিয় সিগন্যাল পরিষেবা চালুর জন্য উদ্যোগ নিলেও কেরানিতলা ছাড়া আর কোথাও চালু হয়নি। তাও সেটিও মাঝে মধ্যে বন্ধ হয়ে যায়। এলআইসি চককে আলো দিয়ে সাজিয়ে ফোয়ারা লাগানো হলেও ফোয়ারা বন্ধ থাকে বেশিরভাগ দিনেই।

সে সব কথা জানিয়ে পুর নাগরিকদের একাংশ বলছেন, কাজ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা কঠিন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE