মেদিনীপুর কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র শুভম কোলে। মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় সে গড়ে ৮৪ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। অঙ্ক-ইংরেজিতে তাঁর প্রাপ্ত নম্বর নব্বইয়ের ঘরে। যদিও কলা বিভাগে প্রাপ্ত নম্বর তুলনামূলক ভাবে কম। একই সঙ্গে স্কুলের অন্য ছাত্রদের সার্বিক ফলও মোটের উপরে সন্তোষজনক।
অন্য দিকে, দশম শ্রেণির টেস্ট পরীক্ষায় গড়বেতা হাইস্কুলের ছাত্র প্রকাশ মণ্ডলের বিজ্ঞান বিভাগে প্রাপ্ত নম্বর কলা বিভাগের তুলনায় কম। সার্বিক নম্বরও ৬৮ শতাংশের কোটায়। স্কুলের অন্য ছাত্রদের সার্বিক ফলও ভাল নয়। প্রকাশের বাবা রাহুল পালের বক্তব্য, “এখানে পড়াশোনার সুযোগ-সুবিধা শহরের তুলনায় কম। তাছাড়া ভাল গৃহশিক্ষকও সব সময় পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে দূরে পড়তে যেতে হওয়ায় সময়ও নষ্ট হয়।”
গ্রাম ও শহরের স্কুল পড়ুয়াদের পরীক্ষার ফলের এই ফারাক দেখা যাচ্ছে পশ্চিম মেদিনীপুরের প্রায় সর্বত্রই। লক্ষণগুলিও প্রায় এক। অর্থাৎ, শহরের স্কুলের পড়ুয়াদের বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে ফল গ্রামের পড়ুয়াদের তুলনায় ভাল। এখন প্রশ্ন কেন এই বৈপরীত্য?
শিক্ষক ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যাচ্ছে, শহরের অভিভাবকরা তুলনায় বেশি সচেতন। তা ছাড়া প্রয়োজনে ভাল গৃহশিক্ষকও শহর এলাকাতেই সহজে মেলে। অন্য দিকে, গ্রামের স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখনও অনেকাংশেই স্কুলের শিক্ষকদের উপর নির্ভরশীল। তা ছাড়া, তুলনায় যারা গ্রামের ভাল ছাত্রছাত্রী তাদের মধ্যে সংলগ্ন শহরের স্কুলে পড়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ফলে গ্রামের পড়ুয়াদের ভিত দুর্বলই থেকে যায়।
তা হলে কি স্কুলের শিক্ষকেরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট আন্তরিক নন?
শিক্ষকেরা অবশ্য সে কথা মানছেন না। উল্টে তাঁরা দুষছেন শিক্ষা ব্যবস্থাকেই। কেমন? মৌপাল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক প্রসূনকুমার পড়িয়া ও নান্দারিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শুদ্ধদেব চট্টোপাধ্যায়ের ব্যাখ্যা, প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ-ফেল নেই! বাছবিচার না করে সকলকেই নতুন ক্লাসে তুলে দেওয়া হচ্ছে। পিছিয়ে পড়া এলাকায় অভিভাবকেরাও ততটা সচেতন নন। একই সঙ্গে তিনি মানছেন, “শিক্ষকদের মধ্যেও পরীক্ষার ফল দেখে পরের বছর সেই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রীদের উপর একটু বেশি করে নজর দেওয়ার ইচ্ছে ততটা নেই। কিছু ক্ষেত্রে সে ইচ্ছে থাকলেও একটি ক্লাসে অতিরিক্ত ছাত্র থাকায় অনেক সময় তা সম্ভবও হয়ে ওঠে না।”
ক্লাসে বেশি ছাত্রের কারণে সকলের দিকে সমান নজর দিতে না পারাও যে ফল খারাপ হওয়ার একটি কারণ উঠে আসছে সেই ব্যাখ্যাও। শিক্ষকেরা জানাচ্ছেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্লাস পিছু ৬০-৭০ জন ছাত্র থাকে। মাত্র একটি পিরিয়ডে সব ছাত্রছাত্রীর প্রতি নজর দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে অনেক ক্ষেত্রে ভাল পড়ুয়ারাও অবহেলার শিকার হয়। শিক্ষক কম থাকায় সব ক্ষেত্রে পড়ুয়াদের একাধিক বিভাগে (সেকশনে) ভেঙে দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে অঙ্ক ও ইংরেজিতে পড়ুয়াদের দুর্বলতা থেকেই যায়। বেলদা গঙ্গাধর অ্যাকাডেমির প্রধান শিক্ষক ননীগোপাল শীলের কথায়, “অঙ্ক ও ইংরেজিতে ভীতি কাটাতে অভিভাবকেরা সচেষ্ট হওয়ায় এক্ষেত্রে ত্রুটি কমেছে। কিন্তু বেশি পড়তে হয় বলে ইতিহাস ও বাংলায় দুর্বলতা বাড়ছে। এ বার সেদিকেও নজর দেওয়া প্রয়োজন।” শুদ্ধদেববাবুর কথায়, “পাশ-ফেল না থাক। কিন্তু তার জন্য কোন বিষয়ে কোন ছাত্র দুর্বল তা চিহ্নিত করে প্রথম থেকেই ওই কোচিং ক্লাসের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।” “বর্তমানে অকৃতকার্য ছাত্রকে একই ক্লাসে রাখা যাবে না। একটু ধমক দিয়ে ভয় দেখাব, সে উপায় নেই। আবার প্রথম থেকেই বিশেষ ক্লাস করে উন্নতি ঘটাব সেই পরিকাঠামো নেই। তাহলে কী ভাবে সার্বিক ফল ভাল হবে।” বক্তব্য শুদ্ধদেববাবুর।
শিক্ষকদের এই সব যুক্তি মেনে নিলেও একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, তবে কি ভাল ফলের জন্য গৃহশিক্ষক ছাড়া গতি নেই? অভিভাবক নীলরতন মহাপাত্রের মতে, “এক জন স্কুলে ভাল করে পড়াচ্ছেন না। অথচ, তাঁর কাছে প্রাইভেট টিউশন দিলেই ছেলে সেই বিষয়ে ভাল করছে। তা হলে কী সব বিষয়ে ওই শিক্ষকদের কাছেই প্রাইভেট টিউশন দিতে হবে!” কেশিয়াড়ির নছিপুর আদিবাসী হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপন পড়িয়া এবং মৌপাল হাইস্কুলের প্রসূন পড়িয়াও মানছেন, “শিক্ষকদের আরও একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে পড়ানো উচিত। প্রয়োজনে বেশি সময় দেওয়াও উচিত।” একই সঙ্গে তাঁদের স্বীকারোক্তি, শিক্ষকদের মধ্যেও এখন ফাঁকি দেওয়ার একটা মানসিকতা তৈরি হয়েছে। পরিকাঠামো নির্মাণে সরকারি সাহায্য, অভিভাবকদের আরও একটু সচেতন হওয়ার সঙ্গে শিক্ষকেরা মনোযোগী হলে সার্বিক ফল অন্য রকম হত। সবাইকে টেস্টে পাশ করিয়ে দেওয়ার পর ফল কেমন হবে তার জন্য দুশ্চিন্তা করতে হত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy