Advertisement
১৯ মে ২০২৪

শিশু পাচারকারী সন্দেহে ট্রেনে হেনস্থা মেদিনীপুরের মহিলাকে

‘তিনটে বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছি, আজই ফিরে আসব’। শনিবার সকালে ট্রেনে যেতে যেতে ফোনে এক পরিচিতকে এমন কথা বলাটাই কাল হল মেদিনীপুর শহরের শরৎপল্লির বাসিন্দা পেশায় আদালতের কর্মী নিবেদিতা মুখোপাধ্যায় মজুমদারের। শিশু পাচারকারী সন্দেহে ট্রেনের সহযাত্রীরা হেনস্থা করলেন তাঁকে। শুনতে হল নানা কটূ কথা।

নিজের বাড়িতে ওই তিন শিশুর সঙ্গে নিবেদিতাদেবী। —নিজস্ব চিত্র

নিজের বাড়িতে ওই তিন শিশুর সঙ্গে নিবেদিতাদেবী। —নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
মেদিনীপুর ও তমলুক শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০১৪ ০২:১০
Share: Save:

‘তিনটে বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছি, আজই ফিরে আসব’।

শনিবার সকালে ট্রেনে যেতে যেতে ফোনে এক পরিচিতকে এমন কথা বলাটাই কাল হল মেদিনীপুর শহরের শরৎপল্লির বাসিন্দা পেশায় আদালতের কর্মী নিবেদিতা মুখোপাধ্যায় মজুমদারের। শিশু পাচারকারী সন্দেহে ট্রেনের সহযাত্রীরা হেনস্থা করলেন তাঁকে। শুনতে হল নানা কটূ কথা। কেউ বললেন, “কত দিন ধরে বাচ্চা চুরির কারবার করছিস?” আবার কারও প্রশ্ন, “আগে এ ভাবে কতগুলো বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে?’ প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে এক সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন নিবেদিতাদেবী। শেষ পর্যন্ত রেল পুলিশ তাঁকে এবং তাঁর সঙ্গে থাকা তিন বালিকাকে উদ্ধার করে।

নিবেদিতার স্বামী বিকাশ মজুমদারও মেদিনীপুর আদালতের কর্মী। একমাত্র ছেলে কলকাতার কলেজে পড়ে। নিবেদিতাদেবী ও বিকাশবাবু ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের সঙ্গে যুক্ত। সেই সূত্রেই দীর্ঘ দিন ধরে এলাকার জনা চল্লিশেক দুঃস্থ ছেলেমেয়ের দেখাশোনা করেন তাঁরা। তাদেরই তিন জন দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী মানসী দুবে এবং তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া রিয়া দাস ও মৌমিতা মুখীকে নিয়ে শনিবার সকালে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কলকাতার বালিগঞ্জের অফিসে যাচ্ছিলেন নিবেদিতাদেবী। মেদিনীপুর থেকে সকাল ৫টা ৪৫ মিনিটের হাওড়া লোকাল ধরেন তাঁরা। ওঠেন মহিলা কামরায়। সেখানেই ঘটে হেনস্থার ঘটনা। নিবেদিতাদেবীর কথায়, “আগেও ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে কলকাতায় গিয়েছি। পুরুলিয়া, পুরীতেও গিয়েছি। এমন অভিজ্ঞতা কখনও হয়নি!”

শনিবার বিকেলে মেদিনীপুরের বাড়িতে বসে নিবেদিতাদেবী জানালেন, ট্রেন বালিচক পেরনোর পরই ঘটে বিপত্তি। ফোনে তখন এক পরিচিতকে তিন বালিকাকে নিয়ে কলকাতা যাওয়ার কথা বলছিলেন নিবেদিতাদেবী। তা শুনে পাশে বসে থাকা মধ্য তিরিশের এক মহিলা যাত্রীর সন্দেহ হয়, নিবেদিতাদেবী বাচ্চা চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছেন। নিবেদিতাদেবী বলেন, “ওই মহিলা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর উঠে গিয়ে আরও কয়েকজন যাত্রীকে নিয়ে এলেন। তারপর শুরু হল জেরা।” নিবেদিতাদেবী বহু বোঝানোর চেষ্টা করেন যে তিনি ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের যুক্ত, ওই তিনটি মেয়ের দেখভাল করেন কিন্তু কেউই তাঁর কথা বিশ্বাস করেনি। নিবেদিতাদেবীর কথায়, “কেউ কথা শুনল না। স্রেফ সন্দেহের বশে হেনস্থা করল।”

ওই ট্রেনে মহিলা কামরার পিছনের কামরায় ছিলেন নিবেদিতাদেবীর পরিচিত শুভাশিস দাস বর্মন। তিনি বলেন, “গোলমাল হচ্ছে শুনে পাঁশকুড়া স্টেশনে ট্রেন থামার পরে আমি মহিলা কামরায় যাই। দেখি নিবেদিতাদি-কে অনেকে মিলে ঘিরে ধরেছে। আমি ওদের বলি, দিদিকে চিনি। উনি এক জন সরকারি কর্মী। কেউ তা বিশ্বাস করেনি। উল্টে আমাকেই বাচ্চা চুরি চক্রের লোক বলে গালমন্দ করে।”

মেচেদা স্টেশন ট্রেন থামার পরে তিন বালিকা-সহ নিবেদিতাদেবীকে নামানো হয়। রেল পুলিশ এসে সব ঘটনা শুনে তাঁদের পাঁশকুড়ায় জিআরপি অফিসে নিয়ে যায়। সেখানেই ডেকে পাঠানো হয় মানসী, রিয়া ও মৌমিতার অভিভাবকদের। তাঁদের নিয়ে আসেন নিবেদিতাদেবীর স্বামী বিকাশবাবু। দুপুরে সবাই মেদিনীপুর রওনা দেন। পাঁশকুড়া জিআরপি-র ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক সুখেন দাস বলেন, “আসলে এখন নানা ঘটনা ঘটছে। ট্রেনের যাত্রীরা তাই ওই মহিলাকে ভুল বুঝেছিলেন।”

রেল পুলিশের ভূমিকায় খুশি নিবেদিতাদেবী। তাঁর কথায়, “রেল পুলিশের সাহায্য না পেলে কী যে হত, ভাবতে পারছি না।”

এ দিন বিকেলে নিবেদিতাদেবীর ঘরে বসেছিল মানসী, রিয়া ও মৌমিতা। সারা দিনের ধকলের ছাপ ওদের চোখে মুখে স্পষ্ট। রিয়ার মা মঞ্জু দাস বলেন, “অন্যের বাড়িতে কাজ করি। মেয়ের দেখাশোনা দিদিই (নিবেদিতাদেবী) করেন। সব শুনে খুব খারাপ লাগছে।” ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মেদিনীপুর শাখার সম্পাদক স্বামী মিলনানন্দের কথায়, “নিবেদিতাদেবী আগেও বাচ্চাদের নিয়ে সঙ্ঘের নানা অফিসে গিয়েছেন। এই ঘটনা অনভিপ্রেত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

mednipure tamluk kidnapper
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE