সংগ্রহশালায় উৎসাহী পড়ুয়াদের ভিড়। নিজস্ব চিত্র।
প্রতিবছরই দিনটা এলেই নতুন কিছু করার চেষ্টায় থাকে আইআইটি। এ বছর নবরূপে সজ্জিত সংগ্রহশালার উদ্বোধন করে পালিত হল হিজলি শহিদ দিবস। মঙ্গলবার খড়্গপুর আইআইটি-র শহিদ ভবনে ব্রিটিশ আমলে হিজলি জেলের বন্দিদের স্মরণ করা হয়। তারপর উদ্বোধন হয় ভারত সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের অর্থানুকূল্যে পুনর্নির্মিত নেহরু মিউজিয়ামের সম্প্রসারিত অংশের। উদ্বোধন করেন ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত ওই সংগ্রহশালার প্রথম চেয়ারম্যান তথা আইআইটি-র প্রাক্তন পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক এসটিএইচ আবিদি।
১৯৩০ সাল। সারা ভারত জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল গোটা দেশ। বাদ নেই বাংলাও। সেই সময় প্রস্তাবিত হিজলি জেলার সদর দফতরটি হয়ে যায় হিজলি বন্দিনিবাস। সেখানেই বিচারাধীন বন্দিদের রাখা হত। পুরুষদের বন্দিশালার অদূরেই ভারতের প্রথম মহিলা সেল গড়া হয়। পুরুষদে বন্দিশালায় এক সময় বন্দি ছিলেন বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখোপাধ্যায়, প্রফুল্ল সেন, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী নৃপেন চক্রবর্তীর মতো বিপ্লবীরা। আর মহিলা জেলে ছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা, সুহাসিনী গঙ্গোপাধ্যায়, সরোজ আভা নাগ, বনলতা দাশগুপ্ত, ইন্দুমতি ঘোষের বীরাঙ্গনারা। ১৯৩১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আসে সেই কালো দিন। রাত ৮টায় ব্রিটিশ পুলিশ ‘পাগলা ঘন্টি’ বাজিয়ে গুলি চালায় নিরস্ত্র বন্দিদের উপর। মৃত্যু হয় দুই বিপ্লবীর। একজন সুভাষচন্দ্র বসুর সহপাঠী ১৮১৮ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজের স্নাতকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া সন্তোষকুমার মিত্র। অন্য জন চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের সহকর্মী তারকেশ্বর সেনগুপ্ত। ওই ঘটনার পরদিন সুভাষচন্দ্র মিছিল করেন। ঠিক দশদিন পরে, ২৬ সেপ্টেম্বর কলকাতার মনুমেন্টের (অধুনা শহিদ মিনার) নীচে প্রতিবাদ সভা করেন রবীন্দ্রনাথ। সেই সভায় বিশ্বকবির দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারিত হয় ‘প্রশ্ন’ কবিতার লাইনগুলি। ১৯৩৭ সালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী। সেই থেকে বন্ধ হয়ে যায় হিজলি বন্দিনিবাস।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চলাকালীন ফের বিচারাধীন বন্দিদের রাখা হয় ওই জেলে। তবে ১৯৪২ সালে এই জেল ফের বন্ধ করে মেদিনীপুর, বক্সা ও ঢাকা জেলে বন্দিদের স্থানান্তর করা হয়। এর পর ওখানে গড়ে ওঠা ব্রিটিশ বায়ুসেনার রেডিও স্টেশনের কাজ ১৯৪৫ সালে শেষ হলে হিজলি জেল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীন ভারতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের উদ্যোগে ১৯৫১ সালের ১৮ অগস্ট থেকে এই ভবনে টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন শুরু হয়। সেই যাত্রা শুরু আইআইটি-র। ১৯৯০ সাল থেকে এই ভবনে চলছে ‘নেহরু মিউজিয়াম অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’। আর মূল প্রতিষ্ঠানটি নতুন ভবনে স্থানান্তরিত হয়ে যায়।
প্রতিবছরই যথাযোগ্য মর্যাদায় শহিদ দিবস পালন করেন আইআইটি কর্তৃপক্ষ। ২০১১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পদার্পণ থেকে পলাশির যুদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের টুকরো টুকরো ছবি নিয়ে একটি প্রদর্শনী চালু হয়। ২০১২ সালে মেদিনীপুরের ইতিহাস ওই গ্যারালিতে ঠাঁই পায়। গত বছর শহিদ প্রদ্যোৎ ভট্টাচার্যের জন্ম শতবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ জানানো হয়েছিল। আর এ বছর নবরূপে সাজিয়ে সর্বসাধারনের জন্য খুলে দেওয়া হল সংগ্রহশালা। প্রতিদিন সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা ও বিকেল ৩টে থেকে সন্ধে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত সংগ্রহশালা খোলা থাকবে। প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে সংগ্রহশালার প্রথম পর্যায়ের কাজ হয়েছে।
সংগ্রহশালায় থাকছে গণিত, পদার্থবিদ্যা, রেল-জলপথ-আকাশপথ পরিবহণ, কম্পিউটর যন্ত্রের নানা মডেল। পুরনো সংগ্রহের সঙ্গে নতুন প্রযুক্তির মডেলই বেশি স্থান পেয়েছে। সংগ্রহশালা পরিদর্শনে ৩০মিনিট সময় লাগছে। শেষে থাকছে হিজলি জেল নিয়ে তথ্যচিত্রের প্রদর্শন। এ দিনের উপস্থিত ছিলেন খড়্গপুর আইআইটি-র ডিরেক্টর পার্থপ্রতিম চক্রবর্তী, আইআইএসইটি-র ডিরেক্টর অজয় রায়, ন্যাশেনাল কাউন্সিল অফ সায়েন্স মিউজিয়ামের ডিরেক্টর জেনারেল জিএস রাওটেলা প্রমুখ। আইআইটির প্রাক্তন অধ্যাপক তথা সংগ্রহশালার প্রাক্তন চেয়ারম্যান অজয় রায় বলেন, “এই সংগ্রহশালার জন্য আমরা অনেক লড়াই করেছি। হিজলি জেল থেকে আইআইটির প্রতিষ্ঠার বহু অজানা কথা তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে এখানে। এতে সাধারণ মানুষ থেকে ছাত্রছাত্রী, সকলে উপকৃত হবেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy