Advertisement
২৩ মে ২০২৪

সৌজন্যের বার্তা নিয়েই মোদী-সফর

পুরভোটে বিজেপির বিপর্যয়ের ঠিক পরেই আগামী শনিবার রাজ্যে পা রাখছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করা রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব যে পুরভোটের ফলাফলে বেশ খানিকটা ধাক্কা খেয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে জেহাদ ঘোষণা করে মোদী দলীয় কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করবেন কি না, সেটাই আপাতত সকলের প্রশ্ন।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৪ মে ২০১৫ ০৪:১৭
Share: Save:

পুরভোটে বিজেপির বিপর্যয়ের ঠিক পরেই আগামী শনিবার রাজ্যে পা রাখছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটকে পাখির চোখ করা রাজ্য বিজেপি নেতৃত্ব যে পুরভোটের ফলাফলে বেশ খানিকটা ধাক্কা খেয়েছেন, তাতে সন্দেহ নেই। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের বিরুদ্ধে নতুন করে জেহাদ ঘোষণা করে মোদী দলীয় কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করবেন কি না, সেটাই আপাতত সকলের প্রশ্ন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্র বলছে, প্রকাশ্য রাজনৈতিক সংঘাত নয়, বরং কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতার বার্তা নিয়েই কলকাতা যাচ্ছেন মোদী। বস্তুত, এটা রাজনীতিক মোদী নয়, প্রধানমন্ত্রী মোদীর পশ্চিমবঙ্গ সফর। যে মোদী ভারত সরকারকে দিল্লির বিজ্ঞান ভবন থেকে বের করে এনে রাজ্যে রাজ্যে নিয়ে যেতে চান। মমতাকে সে কথা জানিয়েওছেন তিনি।

মোদী-মমতার সম্পর্ক ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে অবশ্য জল্পনা বিস্তর। লোকসভা ভোটের প্রচারে মোদীকে তীব্র আক্রমণ করেছিলেন মমতা। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে দীর্ঘ ন’মাস সৌজন্য সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি তিনি। কিন্তু সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে সিবিআই তদন্ত তৃণমূল নেত্রীকে নরম হতে বাধ্য করেছে বলেই অনেকের ধারণা। বস্তুত সিবিআইয়ের তৎপরতা যখন তুঙ্গে, তখনই দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সংসদেও বিভিন্ন বিল পাশের ক্ষেত্রে বিজেপির সহায় হয় তৃণমূল। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, দু’পক্ষে শান্তি-চুক্তি হল কি না। যদিও বিজেপি সূত্রের দাবি, সৌহার্দ্য যা কিছু, তা সবই সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে। রাজনৈতিক প্রশ্নে কোনও আপস করা হচ্ছে না।

৯ তারিখ মোদীর সফর পুরোদস্তুর সরকারি। সে দিন কলকাতা থেকে সামাজিক নিরাপত্তা বিমা ও পেনশন প্রকল্প উদ্বোধন করবেন তিনি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি গত বাজেটেই ‘প্রধানমন্ত্রী সুরক্ষা বিমা যোজনা’, ‘প্রধানমন্ত্রী জীবন জ্যোতি বিমা যোজনা’ ও ‘অটল পেনশন যোজনা’র কথা ঘোষণা করেছিলেন। কলকাতায় সেই প্রকল্পগুলিই চালু করবেন প্রধানমন্ত্রী। কেন্দ্রীয় সরকারি সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রশাসনকে দিল্লি-বন্দি করে না-রেখে রাজ্যে রাজ্যে পৌঁছে দেওয়াই মোদীর লক্ষ্য। তাই তাঁর মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা অন্যান্য রাজ্যে যাচ্ছেন। মোদী নিজের জন্য বেছে নিয়েছেন কলকাতাকে।

মোদীর এই পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে কেন্দ্রের এক মন্ত্রী বলেন, চিরাচরিত ভাবে পুলিশের ডিজি সম্মেলন দিল্লির বিজ্ঞান ভবনেই হয়ে এসেছে। কিন্তু মোদী এই সম্মেলনকে নিয়ে গিয়েছেন গুয়াহাটিতে। সেখানে তিনি রাজ্যপালের সঙ্গে যেমন দেখা করেছেন, তেমনই রাজ্যের কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের সঙ্গেও কথা বলেছেন। প্রধানমন্ত্রী মনে করেন,
গগৈ বিজেপির নন বলে সে রাজ্যে সম্মেলন করা যাবে না, তেমন ভাবনা অর্থহীন। বরং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোতে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলি তিনি ক্রমান্বয়ে লখনউ, পটনা, চেন্নাই থেকেই চালু করতে চান।

তবে রাজনীতিকদের একাংশের মতে, এই সব প্রশাসনিক বয়ানের তলায় তলায় রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতাও কিছু কম নয়। তাঁদের মতে, রাজ্যসভায় সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই বলেই মোদী ও তাঁর মন্ত্রীদের ছুটতে হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে। কারণ, বিভিন্ন বিল পাশ করানোর জন্য তৃণমূল-সহ আঞ্চলিক দলগুলির সমর্থন প্রয়োজন। বিমা ও খনি বিলে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়েছে তৃণমূল। পণ্য-পরিষেবা কর বিল সমর্থন করার কথা ঘোষণা করেছে তারা। গত কাল রাহুল গাঁধী যে বিল নিয়ে সরব হয়েছেন, সেই রিয়েল এস্টেট বিলও তৃণমূল সমর্থন করবে বলেই খবর।

কিন্তু মোদী সরকারের সামনে এই মুহূর্তে বড় কাঁটা জমি বিল। তৃণমূল এই বিলের বিরোধী। মুখ খুলেছে কয়েকটি আঞ্চলিক দলও। যদিও সরকারি সূত্রে খবর, অনেক মুখ্যমন্ত্রীই জমি বিলকে ব্যক্তিগত ভাবে সমর্থন করে চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু দলগত অবস্থানের কারণে তাঁদের বিরোধিতা করতে হচ্ছে। এই অবস্থায় আঞ্চলিক দলগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে, তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সাহায্য (অর্থাৎ রাজ্যসভায় ভোটাভুটিতে বিরত থাকা বা ওয়াক আউট করে সরকার পক্ষের সুবিধা করে দেওয়া) নিয়ে বাধা পেরোতে চাইছে কেন্দ্র।

তৃণমূলের সঙ্গেও এই ধরনের একটা বোঝাপড়ায় আসার চেষ্টা করছে বিজেপি। সেই সূত্র ধরেই মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখে চলছে মোদী সরকার। বিজেপি সূত্রের দাবি, সারদা-কাণ্ডে সিবিআই থেকে বাঁচতে চাইছেন মমতাও। তাঁরও বিজেপি-কে দরকার। সুতরাং সমঝোতা একটা হতেই পারে।

কিন্তু রাজ্যে বিজেপির কর্মকাণ্ডে এর কী প্রভাব পড়বে? ‘ভাগ মমতা ভাগ’ স্লোগান দিয়ে তৃণমূল-বিরোধিতা তুঙ্গে তোলার পরে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বও কি পিছিয়ে আসবেন? বিজেপি সূত্র বলছে, বনগাঁ উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয় এবং দিল্লিতে বিজেপির হারের পর থেকেই হাওয়া কিছুটা ঘুরতে শুরু করেছে। প্রকাশ্য সংঘাত থেকে সরে এসে কেন্দ্র-রাজ্য সৌজন্য ও সৌহার্দের বার্তা দেওয়ার চেষ্টার শুরু তখন থেকেই। রাজ্যের পুরভোটেও বিজেপি ধরাশায়ী হওয়ার পরে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব নতুন করে সংঘাতে যাওয়ার উপযোগিতা দেখছেন না বলেই খবর। বিরোধীদের একাংশের দাবি, সারদা তদন্ত যে দৃশ্যত কিছুটা স্তিমিত হয়েছে, তার পিছনেও রয়েছে রাজনীতির এই অঙ্ক। তাঁরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, অনতি অতীতে মমতা নিজেই গঙ্গাদূষণ সংক্রান্ত বৈঠকে না গিয়ে মোদীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অতিক্রম করার অভিযোগ তুলেছিলেন। এখন মোদী সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে তুলে ধরার লক্ষ্য নিয়েই কলকাতা যাচ্ছেন। এর মধ্যে রাজনৈতিক বার্তাটি অপ্রচ্ছন্ন নয় বলেই তাঁদের মত।

অমিত শাহ বা অরুণ জেটলি অবশ্য প্রকাশ্যে দাবি করছেন, মোদী-মমতা বাড়তি ঘনিষ্ঠতার কোনও প্রশ্নই নেই। জেটলির কথায়, ‘‘সকলেই জানেন, রাজ্যসভায় সরকার পক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এই অবস্থায় সমর্থনের জন্য আমি বা বেঙ্কাইয়া নায়ডু যদি বিভিন্ন দলের সঙ্গে কথা বলি, তাতে অবাক হওয়ার কী আছে?’’ অমিত শাহ বলেন, ‘‘বিরোধী দল মানেই যে শুধু বিরোধিতা করবে, তার কী মানে আছে? কেউ যদি সরকারকে সমর্থন করে, তার মানেই যে সেই দলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল, তা নয়।’’ কেন্দ্রীয় সূত্রের দাবি, যদি মমতাকে ছেড়েই কথা বলত বিজেপি, তা হলে তৃণমূল সাংসদ কে ডি সিংহের বাড়িতে আয়কর হানা হতো না। মমতাও মনে করেন, ‘‘বিজেপির সঙ্গে কোনও আপসের প্রশ্নই উঠছে না। কিন্তু আমি সৌজন্যের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। কেন্দ্রীয় সরকার যেমন রাজ্যকে ছাড়া চলতে পারে না, তেমনই রাজ্য চালাতে গেলেও কেন্দ্রকে বাদ দিয়ে হয় না।’’

রাজ্য বিজেপির একাংশ অবশ্য কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন। তাঁরা মনে করছেন, মমতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাটি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের থেকেও বেশি মাত্রায় গিয়ে পৌঁছেছে। এবং এতে আখেরে ক্ষতি হচ্ছে রাজ্য বিজেপির। কারণ দলগত ভাবে তারা যতই আক্রমণাত্মক মনোভাব নিক না কেন, কেন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার বার্তা যাওয়ায় ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ভারপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ এই মর্মে একটি রিপোর্টও পেশ করেছেন অমিত শাহের কাছে। গত শুক্রবার মোদী সরকারের মন্ত্রী হর্ষবর্ধন যে ভাবে মমতাকে ‘লড়াকু নেত্রী’ বলে তারিফ করেছেন, তাতে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। কারণ, হর্ষবর্ধন প্রধানমন্ত্রীর সায় ছাড়া এমন মন্তব্য করেছেন বলে বিজেপির কেউই বিশ্বাস করেন না।

ফলে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যতই মুখে বলুন না কেন যে, বিধানসভা নির্বাচনে দল যে সর্বশক্তি নিয়েই ঝাঁপাবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না বিজেপির রাজ্য নেতারা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE