ভাইজান, কিছু একটা ব্যবস্থা করুন।
কঠিন মুখে মাথা নেড়ে তরুণীর এমন কাতর অনুরোধ ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন যিনি, তিনি মঙ্গলবার পর্যন্তও পেট্রাপোলে মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রে বসে লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশি টাকা ভাঙিয়ে পড়শি দেশের নাগরিকদের হাতে ধরিয়েছেন। কিন্তু আজ তাঁর ভাঁড়ার খালি। ঘুরপথে বেশি টাকা ‘বাটা’ নিয়ে অবশ্য টাকা পেয়েছেন কেউ কেউ।
প্রভাব পড়েছে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলের রফতানিতে। পার্কিংয়ের খরচ বাবদ ৫০০-১০০০ টাকার নোট নেওয়া হবে না বলে নোটিস দেওয়া হয়েছিল সিডব্লুসিতে (পার্কিং জোন)। ফলে এ দিন ৪০০ ট্রাকের মধ্যে শ’দেড়েক ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকতে পেরেছে।
‘পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিভিন্ন জায়গা থেকে খুচরো টাকা জোগাড় করে কোনও রকমে দেড়শো ট্রাক পাঠানো গিয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে কী হবে, ভাবতেই পারছি না। এমন চলতে থাকলে রাজস্ব সংগ্রহে প্রভাব পড়বে।’’
একটি বেসরকারি সংস্থার অধীনে পেট্রোপোল বন্দরে ৬০টি মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র আছে। ওই সংস্থার ম্যানেজার আশিস দে বলেন, ‘‘অনেক কম মানুষ যাতায়াত করেছেন। ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে এক একটি মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রের জন্য ১০ হাজার করে টাকা দেবে। কিন্তু ওই সামান্য টাকা কাকে ভাঙিয়ে দেবো, কাকে ফেরত পাঠাব, ভেবে পাচ্ছি না।’’ ২৫ তারিখ পর্যন্ত এমন টালমাটাল অবস্থা চলবে বলে ব্যাঙ্কের তরফে মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্রগুলিকে জানানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আশিসবাবু।
এই পরিস্থিতিতে বহু বাংলাদেশি নাগরিক সীমান্ত পেরিয়ে এ দেশে এসে উপায়ান্তর না দেখে ফিরে গিয়েছেন। শুধু মাত্র যাঁরা চিকিৎসার জন্য এসেছেন, তাঁদের কাছ থেকে ২০০ বাংলাদেশি টাকার বিনিময়ে ১৮০ টাকা দিয়েছেন এ দেশের মুদ্রা বিনিময় ব্যবসায়ীরা। সেটা শুধু কলকাতা পর্যন্ত যাওয়ার ভাড়া হিসাবে!
কার্তিক ঘোষ নামে এক মুদ্রা বিনিময়কারী বলেন, ‘‘আমাদের কাছে ৫০০-১০০০ টাকার নোট অনেক আছে। কিন্তু সে সব দিয়ে ওঁদের বিপদে ফেলার কোনও মানে হয় না। আর এত একশো টাকার নোট কোথা থেকে জোগাড় করব? ব্যাঙ্কও তো বন্ধ। এটিএম কাজ করছে না। ফলে কাউন্টার খোলা রাখলেও মুদ্রা বিনিময় বন্ধ রাখতে হয়েছে।’’
অন্য একটি কাউন্টারের কর্মী বাপ্পা ঘোষ জানালেন, যাঁদের খুব প্রয়োজন, কলকাতায় ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছেন বলে কাকুতি-মিনতি করছেন, তাঁদের ২০০ টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রা) ভাঙিয়ে হিসেব মতো ১৮০ টাকা দিচ্ছি।’’ পেট্রাপোলে এ রকম শ’খানেক মুদ্রা বিনিময় কেন্দ্র আছে। সব জায়গাতেই এই অবস্থা।
ফরিদপুরের বাসিন্দা প্রেমানন্দ দাস এসেছেন চোখের চিকিৎসা করাতে। বললেন, ‘‘ভারতে রাতারাতি এমন ঘটনা ঘটে গিয়েছে, জানতামই না। এখানে এসে তো খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম! শুনছি নাকি চিকিৎসা করাতে গেলে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে না। এখন দেখা যাক, কলকাতায় গিয়ে কী আছে কপালে!’’
কল্যাণীতে আত্মীয়ের বাড়িতে যাবেন বলে এ দেশে এসেছেন চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকের বাসিন্দা খালেজা বেগম। একটা টাকাও কেউ তাঁকে ভাঙিয়ে দিচ্ছিল না। গলদঘর্ম অবস্থা মহিলার। কিছুক্ষণ পরে এক যুবককে কানের কাছে গুজগুজ করতে দেখা গেল। ওই যুবকের সঙ্গে কোণের দিকের একটি গুমটির দিকে গেলেন মহিলা। ফিরে এলেন যখন, মুখে স্বস্তির হাসি। জানালেন, ২ হাজার টাকা (বাংলাদেশি) দিয়ে দেড় হাজার টাকা পেলেন। আপাতত এতেই কাজ চলবে। অন্য সময় সঠিক দর মেনে ১৮০০ টাকা পাওয়ার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু জানা গেল, এই ব্যবস্থাতেও সমস্যা আছে। কারণ, অতিরিক্ত ‘বাটা’ নিয়েও কাউকে ২ হাজার টাকার বেশি ভাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সেলিমা খাতুনের শান্তিনিকেতনে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। সব দেখেশুনে অবশ্য ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’ থেকে ফিরে গেলেন তিনি। শুধু যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘‘অর্থের জন্য এমন অনর্থ ঘটবে, ভাবিনি!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy