Advertisement
০২ মে ২০২৪

ছেলেকে লক্ষ্যে পৌঁছতে টোটো নিয়ে রাস্তায় মা

পোয়াবাগান যাবেন? বাঁকুড়া সদরের মাচানতলার মোড়ে দাঁড়ানো টোটোর চালকের আসনের দিকে না তাকিয়েই বলেছিলেন গঙ্গাজলঘাটির শ্রীরাম গড়াই। বামা-কণ্ঠে ‘হ্যাঁ’ শুনে হতবাক। টোটো-চালক মহিলা!

চালকের আসনে সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

চালকের আসনে সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়। ছবি: অভিজিৎ সিংহ।

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
বাঁকুড়া শেষ আপডেট: ১০ জুন ২০১৬ ০৩:৩৩
Share: Save:

পোয়াবাগান যাবেন? বাঁকুড়া সদরের মাচানতলার মোড়ে দাঁড়ানো টোটোর চালকের আসনের দিকে না তাকিয়েই বলেছিলেন গঙ্গাজলঘাটির শ্রীরাম গড়াই। বামা-কণ্ঠে ‘হ্যাঁ’ শুনে হতবাক। টোটো-চালক মহিলা!

মাস দু’য়েক হল টোটো চালাচ্ছেন বাঁকুড়া শহরের সানবাঁধার বছর পঁয়তাল্লিশের গৃহবধূ সুচিত্রা মুখোপাধ্যায়। শহর তাঁকে চেনে ‘পুতুনদি’ বলে। ছেলে অভিষেক সদ্য কলেজে ঢুকেছেন পাঁচমুড়া কলেজে অঙ্কে অনার্স নিয়ে। ইচ্ছে, ডক্টরেট করার। ছেলেকে লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে টোটো নিয়ে টো-টো করছেন মা।

সুচিত্রা জানালেন, ঘরেতে অভাব বলে তাঁর পড়াশোনা মাধ্যমিক পর্যন্ত। নিজের পছন্দে বিয়ে বাঁকুড়া শহরের এক ওষুধের দোকানের কর্মী শান্তি মুখোপাধ্যায়কে। নেমেছিলেন সক্রিয় রাজনীতিতে। ২০০৪ সালে বাঁকুড়া ২ পঞ্চায়েত সমিতির খাদ্য কর্মাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন ফরওয়ার্ড ব্লকের হয়ে। কিন্তু সে দলের মতাদর্শ নিয়ে চলতে অসুবিধা হওয়ায় কয়েক মাসের মধ্যেই পদত্যাগ পত্র জমা দিয়ে বসেন। তা অবশ্য গৃহীত হয়নি।

টোটো নিয়ে রাস্তায় নামাটাও বিনা ঝামেলায় হয়নি। ছেলে যখন কলেজের দোরগোড়ায়, তখন পারিবারিক আয় হাজার তিনেক টাকা। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে একটি টোটো কিনেছিলেন শান্তিবাবু। কিন্তু লোক রেখে তা চালাতে গিয়ে ঢাকের দায়ে শীতলা বিক্রির জোগাড়। সুচিত্রা সিদ্ধান্ত নেন নিজেই টোটো চালাবেন। কারণ, টোটো চালাতে গেলে শান্তিবাবুকে চাকরি ছাড়তে হতো। ডকে উঠতো ছেলের পড়াশোনা।

সুচিত্রা বলে চলেন, ‘‘স্বামী-ছেলের মত ছিল না। কিন্তু মেয়ে হয়ে জন্মেছি বলে শুধু রান্নাঘর সামলানোই আমার কাজ নয়। প্রয়োজনে দায়িত্বও নিতে পারি।” রোজ সকাল ৭টা নাগাদ টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ফিরতে দুপুর। রান্না করে, খেয়ে-খাইয়ে ফের বিকেলে বেরোনো। ফিরতে রাত। তবে এই খাটনির দৌলতে মাস গেলে আরও হাজার তিনেক টাকা হাতে আসছে তাঁর।

ট্রেন-ট্যাক্সি পেরিয়ে মহিলা পাইলটদের যুদ্ধবিমানও ওড়াতে দেখছে এ দেশ। বাঁকুড়া শহরও মানিয়ে নিচ্ছে টোটো-সুচিত্রায়। বাঁকুড়া ই-রিকশা ইউনিয়নের সভাপতি হিরণ চট্টরাজ, শহরের বাসিন্দা লেখিকা মহামায়া মুখোপাধ্যায়, গাড়িচালক বাপি বন্দ্যোপাধ্যায়েরা এক কথায় বলছেন, ‘‘পুতুনদি পথ দেখাচ্ছেন।’’ জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘সাহস লাগে এমন কাজ করতে। ওঁকে কুর্নিশ।’’ রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর

মন্তব্য, ‘‘মহিলারা সর্বস্তরে নিজেদের প্রমাণ করছেন। সুচিত্রাদেবীও একজন দৃষ্টান্ত।’’

মানছেন ঘরের পুরুষেরাও। শান্তিবাবু বলেন, “ও অসুবিধায় পড়বে ভেবে বাধা দিয়েছিলাম। এখন মুখে কুলুপ আমার।’’ অভিষেকের উপলব্ধি, ‘‘পড়া শেষ করেই মায়ের পাশে দাঁড়াব।’’

রিকশা বা অন্য টোটো চালকদের সঙ্গে যাত্রী নিয়ে ঝামেলা, মহিলা বলে উড়ে আসা কটূক্তিতে অস্বস্তি হয় না? সুচিত্রার স্বীকারোক্তি, ‘‘হয়।’’ তবে জুড়ে দিচ্ছেন, ‘‘গায়ে মাখি না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Toto Student
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE