Advertisement
১৭ জুন ২০২৪

আস্তাবল মাঠ আজও কিস্তিমাতের ঘোড়া

ইতিহাস এখানে থেমে গিয়েছে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সুবে বাংলার রাজধানীতে আছে শুধু ধূসর স্মৃতি। সেই স্মৃতিকে নিয়ে কোনও রকমে বেঁচে রয়েছে মুর্শিদাবাদ। লালবাগ হিসেবেই যা পরিচিত। ১৭০৩ সালে নবাব মুর্শিদকুলির শাসনের সময় থেকে ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধেরও কয়েক বছর পর পর্যন্ত লালবাগই ছিল বাংলা-বিহার-ওড়িশা নিয়ে গড়ে ওঠা সুবে বাংলার রাজধানী।

লালবাগ আস্তাবল। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

লালবাগ আস্তাবল। ছবি: গৌতম প্রামাণিক।

অনল আবেদিন
লালবাগ শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৫ ০০:৩১
Share: Save:

ইতিহাস এখানে থেমে গিয়েছে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার সুবে বাংলার রাজধানীতে আছে শুধু ধূসর স্মৃতি। সেই স্মৃতিকে নিয়ে কোনও রকমে বেঁচে রয়েছে মুর্শিদাবাদ।

লালবাগ হিসেবেই যা পরিচিত। ১৭০৩ সালে নবাব মুর্শিদকুলির শাসনের সময় থেকে ১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধেরও কয়েক বছর পর পর্যন্ত লালবাগই ছিল বাংলা-বিহার-ওড়িশা নিয়ে গড়ে ওঠা সুবে বাংলার রাজধানী। কেমন ছিল সে সময়ের লালবাগ? হাতি-ঘোড়ার আস্তাবল দেখলেই তা বোঝা যাবে।

নবাবদের রাজত্বের সময়ে এখানে ঘোড়াশালে ঘোড়া ছিল। হাতিশালে ছিল হাতি। এখন আর সেই নবাব নেই। হাতি-ঘোড়াও উধাও আস্তাবল থেকে। নবাবের সেই ঘোড়াশাল, হাতিশাল ছিল বর্তমান লালবাগ শহরের মাঝামাঝি এলাকায়। হাতি-ঘোড়া রাখা হত বলে ওই এলাকার নাম ছিল আস্তাবল। এ কারণেই ওই মোড়ের নাম আস্তাবল মোড়। সেখানে নবাবি আমলে তৈরি হয় আস্তাবল। বিশাল চত্বর জুড়ে ১২ থেকে ১৪ ফুট পরিধির মতো থাম। উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মাথায় চাপানো রয়েছে শাল কাঠের ২২-২৫ ফুট দৈর্ঘ্যের পেল্লায় তির। তিরের মাথায় সাল কাঠের বরগা। বরগার উপর চুন-সুরকির ছাদ। সেখানেই থাকত নবাবের হাতি ও ঘোড়া।

হাতি-ঘোড়া উধাও আস্তাবল থেকে। পড়ে আছে কেবল ধূসর স্মৃতি। এখন তার জরাজীর্ন দশা। ঐতিহাসিক ইমারত এখন যেন ভেঙে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। হাতি-ঘোড়ার বদলে সেখানে রয়েছে সিমেন্ট, চিনি, রেশনদ্রব্য, মিড ডে মিলের খাদ্যশস্য, চাল, আলু ও সব্জির গুদামঘর। এ ছাড়া রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এবং কো-অর্ডিনেশন কমিটির তালাবন্ধ কার্যালয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ওই চত্বরেই বসে শহরের সবচেয়ে বড় সব্জি বাজার। ব্যবসায়ী ও ক্রেতা মিলিয়ে দৈনিক কয়েক হাজার লোকের সমাগম হয়। সূর্য ডুবলেই ভুতুড়ে হয়ে ওঠে আস্তাবল। সেই ভুতুড়ে পরিবেশে সন্ধ্যা নামতেই চুল্লু ও দেশি মদের ঠেক বসে। মদ্যপদের হল্লা শুরু হয়। পুলিশ অবশ্য নিয়ম মেনে আসা-যাওয়া করে। তবে তাতে পরিবেশ খুব একটা পাল্টে যায় না। ‘আগমার্কা খাঁটি সরষের তেল’-এ ভেজাল কারবারিরা রাতের অন্ধকারে এখানে ‘পাম অয়েল’ মেশায় বলে অভিযোগ।

বরাত জোরে এখনও অবশ্য হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েনি আস্তাবল। তবে বাসিন্দাদের দাবি দুর্ঘটনা কেবল সময়ের অপেক্ষা। ভেঙে পড়লে কত জন মারা যাবে তা নিয়ে চায়ের দোকানে তুফান তোলেন স্থানীয়েরা। সেই আশঙ্কার কথা জানিয়ে ইতিমধ্যেই ‘সিটি মুর্শিদাবাদ ব্যবসায়ী সমিতি’র পক্ষ থেকে প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে দরবার করা হয়েছে।

সংগঠনের সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “প্রাণ না গেলে বোধ হয় প্রশাসনের টনক নড়ে না!” আস্তাবল ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় শতাধিক সব্জি ব্যবসায়ী খাজনা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘জীবিকার কারণে বাধ্য হয়ে প্রাণ হাতে করে আস্তাবল চত্বরে ব্যবসা করতে হয়। অনেক আবেদন-নিবেদন করেও আস্তাবল সংস্কার না করায় মুর্শিদাবাদ নবাব এস্টেটকে খাজনা দেওয়া বন্ধ করেছি। আস্তাবল সংস্কার করলে খাজনা দেওয়া শুরু করব।”

আস্তাবল লাগোয়া ঐতিহাসিক মাঠও ধ্বংসের পথে। মাঠে এবং মাঠ লাগোয়া পুকুরে এক সময়ে হাতি-ঘোড়ার স্নান এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হত। এখন সেখানে নবাব কাপ-সহ যাবতীয় ফুটবল, ক্রিকেট এবং নানা ধরনের খেলার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। সিএবি-র অনুধ্বর্র্ ১৪ ও অনুর্ধ্ব ১৬ মিলিয়ে ৬০ জনের ক্রিকেট কোচিং চলছে বছর দুয়েক ধরে। প্রাক্তন ও বর্তমান মিলিয়ে তিন জন মুখ্যমন্ত্রী--জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আস্তাবলের মাঠে বহুবার সভা করেছেন। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও এখানে সভা করেছেন। মুর্শিদাবাদ জেলা চেম্বার অব কর্মাসের যুগ্ম সম্পাদক এবং মুর্শিদাবাদ পর্যটক সহায়তা কেন্দ্রের সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “কৃষিমেলা, ফুলমেলা থেকে রেল পর্যন্ত সকলের প্রদর্শনীও হয়েছে এই মাঠের সুবাদেই।”

বিশাল মাঠ, পুকুর ও আস্তাবল মিলিয়ে পুরো সম্পত্তির মালিক এখন রাজ্যের আইন দফতরের অধীনে থাকা মুর্শিদাবাদ এস্টেট। তার ম্যানেজার প্রলয় রায়চৌধুরী বলেন, “আস্তাবল ভবন সংস্কার করার জন্য ব্যবসায়ীদের আবেদন পেয়েছি। সেই আবেদনপত্র-সহ আমাদের রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে আইন দফতরে।” ধরা বাঁধা প্রশাসনিক ওই কথার বাইরে যে এক চুল কাজও এগোয়নি তা এলাকায় গেলেই পরিস্কার হয়। লালবাগের প্রাচীনতম ক্লাব বান্ধব সমিতির সম্পাদক বৈকুণ্ঠ মণ্ডল বলেন, “সরকারি ভাবে মুর্শিদাবাদ এস্টেট মালিক হলেও খেলাধুলার জন্য প্রয়াত নবাব ওয়াসেফ আলি মির্জা মাঠের ভার দিয়েছিলেন বান্ধব সমিতির ওপরেই।” সরকারি নথিপত্র ঘেঁটে স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “বান্ধব সমিতির নামে ওই মাঠের মালিকানা হস্তান্তরের বিষয়ে ১৯৮৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হয়েছিল। বৈঠকে ছিলেন রাজ্যের তত্‌কালীন আইনমন্ত্রী আব্দুল কায়ুম মোল্লা এবং মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের সভাধিপতি প্রয়াত নির্মল মুখোপাধ্যায়। তাতেও কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি।” পলাশির যুদ্ধ পরবর্তী কালের সুবে বাংলার দ্বৈত শাসনের মতো আস্তাবল মাঠেরও কপাল পুড়েছে। মাঠের দায়িত্বহীন মালিকানা রয়েছে মুর্শিদাবাদ এস্টেটের হাতে। আর, ক্ষমতাহীন ভোগদখলের অনুমতি রয়েছে বান্ধব সমিতির।

মাঠের উত্তর দিক আস্তাবল ভবনের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকে রয়েছে মাঠের থেকে ফুট তিনেকে উঁচু পাকা সড়ক। বান্ধব সমিতির সভাপতি রাধামাধব সরকার বলেন, “নৌকার মতো আকৃতি পাওয়া ওই মাঠ সারা বর্ষাকাল ডুবে থাকে হাঁটু জলে।” তবুও অতীতে মনের জোরে ওই মাঠ কাঁপানো স্থানীয় ফুটবলারদের অনেকেই কলকাতার টিমে জায়গা পেয়েছেন। গত দু’বছরের কোচিং পেয়ে কলকাতার ক্রিকেট টিমে জায়গা করে নিয়েছে চার কিশোর হুমায়ুন শেখ, প্রিতম মার্জিত, অভিজিত্‌ মণ্ডল ও বাপি দাস। তাই খানাখন্দে ভরা আস্তাবল মাঠ আজও কিস্তিমাতের জন্য আমজনতার কাছে কালোঘাড়া।

ঐতিহাসিক শহরের আজও প্রভাতি ও সান্ধ্য ভ্রমণের সঙ্গী আস্তাবল মাঠ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

anal abedin lalbagh amar shohor
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE