Advertisement
০৬ মে ২০২৪

পেট পুরে দই-মিষ্টি খেয়ে ঝাঁপ নদীতে

বৃদ্ধ চুপ করে চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে। রবিবার জীবন রাখবেন না বলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ভাগীরথীর জলে। ভেসেও যাচ্ছিলেন।

নিজের বাড়িতে বিশ্বনাথ ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

নিজের বাড়িতে বিশ্বনাথ ঘোষ। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
শান্তিপুর শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

কথা বলতে বলতে ভিজে যায় দুই চোখ। মলিন ধুতির খুঁট দিয়ে মুছে বছর আশির বৃদ্ধ বলেন, ‘‘অনেক বেঁচেছি, আর বাঁচতে চাই না। আসলে, বেশি বয়স পর্যন্ত বেঁচে থাকাটাও বোধহয় ঠিক নয়। এটা বুঝতে কেন যে এত দেরি হয়ে গেল!’’

আর সেটা বুঝেই কি এমন কাণ্ড করেছিলেন? কোনও উত্তর মেলে না। বৃদ্ধ চুপ করে চেয়ে থাকেন আকাশের দিকে। রবিবার জীবন রাখবেন না বলে ঝাঁপ দিয়েছিলেন ভাগীরথীর জলে। ভেসেও যাচ্ছিলেন।

নদীতে তখন মাছ ধরছিলেন স্থানীয় এক যুবক। এ ভাবে এক জনকে ভেসে যেতে দেখে তিনি দ্রুত ডিঙি চালিয়ে তাঁকে ধরে ফেলেন। কিন্তু একা কোন ভাবেই ডিঙিতে তুলতে পারছিলেন না। গবারচরের বাসিন্দা বছর ছাব্বিশের শম্ভু বিশ্বাস বলছেন, “অসহায় লাগছিল তখন। কেবলই মনে হচ্ছিল যে, এত করেও কি মানুষটাতে বাঁচাতে পারব না?”

তখনই শোনা যায় ভুটভুটির শব্দ। গবারচরের বাসিন্দা বেলগড়িয়া ২ গ্রাম পঞ্চায়েতের সদস্য তৃণমূলের কৃষ্ণপদ রাহা সোশ্যাল অডিট টিম নিয়ে যাচ্ছিলেন নদীর বুকে জেগে ওঠা চরে। ওই ভাবে এক জনকে ডিঙিতে টেনে তোলার চেষ্টা করতে দেখে তারাও চলে আসেন ভুটভুটি নিয়ে। সকলে মিলে তাঁকে টেনে তোলেন নিজেদের ভুটভুটিতে।

বিশ্বনাথ ঘোষ। বাড়ি হিজুলি। বয়স প্রায় আশি বছর। তিন ছেলে এক মেয়ে। ছোট ছেলেকে কিছুটা দূরে বাড়ি করে দিয়েছেন। দুই ছেলে তাকে পৈতৃক বাড়িতে। তবে হাঁড়ি আলাদা। স্ত্রী পান্নাদেবীকে নিয়ে আলাদা থাকেন বৃদ্ধ। দোতলা বাড়ির উপরের তলায় একটা ঘরে থাকেন স্ত্রীকে নিয়ে। প্রায় ১৫ বিঘা জমিতে চাষ করেন ছেলেরা।

আর তাঁর ভাগে? স্ত্রীকে দেখিয়ে বৃদ্ধ বলেন, “ওই যে, চরকা কাটছে।” গলায় ফের অভিমান। দোতলার বারান্দায় ছড়িয়ে আছে চরকা আর সুতো। পড়শিরাও জানাচ্ছেন, বৃদ্ধের জমি ছেলেরা চাষ করেন। তাঁদের দয়াতেই চলে দুই বৃদ্ধ-বৃদ্ধার জীবন। সঙ্গে মোটা টাকার ওষুধ।

ছেলেদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই লেগে থাকে অশান্তি। পান্নাদেবী বলেন, “ওর শুধু একটাই চিন্তা, ছেলেরা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারল না। মাঝে মধ্যেই এই রুগ্‌ণ শরীর নিয়ে মাঠে যাবে আর ছেলেদের বকাঝকা করবে। এই বয়সের ছেলেরা কি সেটা মানতে পারে? আমি ছেলেদের হয়ে কোনও কথা বললেই রেগে যায়।”

নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার পরে অনেকটাই যেন মিইয়ে গিয়েছেন মানুষটা। শুধু চারদিকের প্রিয় মুখগুলোর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন আর বলেন, “আমি কিন্তু তোমাদের বিরুদ্ধে কিছু বলিনি গো।”

কিন্তু সে কথা মানতে নারাজ শান্তিপুরের গবারচরের মানুষ। তাঁদের কথায়, “বৃদ্ধ আমাদের পরিষ্কার বলেছেন, তাঁকে কেউ ভালবাসে না বলেই তিনি মরতে চেয়েছিলেন।” পঞ্চায়েত সদস্য কৃষ্ণপদ রাহা বলেন, “প্রথমে কিছুই বলতে চাইছিলেন না। পরে কেঁদে ফেলেন। বলেন, পারিবারিক সমস্যার কারণেই তিনি আত্মঘাতী হতে চেয়েছেলেন।”

খবর পেয়ে ছেলেরা নিতে এলে গবারচরের লোক তাদের দিয়ে মুচলেকা লিখিয়ে নিয়েছেন যে , ভবিষ্যতে তাঁরা এমন কিছু করবেন না যাতে দ্বিতীয় বার আত্মঘাতী হওয়ার কথা ভাবতে হয় বৃদ্ধকে।

স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার সকালে তিনি বাড়ি থেকে বের হন হাঁটার নাম করে। সেখান থেকে টোটো ধরে যান সোজা হিজুলি বাজারে। সেখান থেকে লছিমনে করে শান্তিপুর ডাকঘর মোড় হয়ে সোজা শ্যামচাঁদ মন্দিরে। তার পরে মিষ্টির দোকানে ঢুকে খান কচুরি, দই আর মিষ্টি। সেখান থেকে ফের টোটোয় করে বড়বাজার ঘাট।

ভাগীরথীর তীর ধরে বেশ কিছুটা হেঁটে ফাঁকা দেখে জুতো, জামা আর ধুতি খুলে রেখে ঝাঁপ দেন ভাগীরথীর জলে। সোমবার বিশ্বনাথবাবুর ছেলে-বৌমা বলছেন, ‘‘বয়স বেড়েছে। বেড়েছে অভিমানও। তবে এমন আর কিছু করব না যাতে উনি কষ্ট পান।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE