ডোমকলের ভাতচালা গ্রামের ঘোর বৃদ্ধ আসরাফুদ্দিন মরা নদীটার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন— ‘‘বুঝলেন গিয়ে, কর্তা ছেলেবেলার নদীটারে পুকুরে এক্কারে গ্রাস করত্যাসে!’’
ত্রিশ বছর পিছনে হেঁটে যাচ্ছেন আসরাফুদ্দিন। বলছেন, ‘‘আষাঢ়-শ্রাবণে মাঠ ভাইস্যা যাইত, আমরা পোলাপান লইয়্যা স্বজনের বাড়ি, অন্য গাঁয়ে পলাইয়্যা যাইতাম।’’
সেই বর্ষা আছে, কিন্তু হারিয়ে গিয়েছে শেয়ালমারি। শুধু বর্ষা কেন, ফেঁপে ওঠা নদী, ভরা জৈষ্ঠ্যেও হাঁটু জল নিয়ে দিব্যি বয়ে যেত জলঙ্গির দিকে, ‘‘সম্বৎসর টইটুম্বুর’’, অস্ফূটে ফুট কাটছেন বৃদ্ধ।
আশশ্যাওড়ার ঝোপ আর পাঁকাল জলে পানা-পদ্মের দল সরিয়ে শেয়ালমারির বুকে-পেটে এখন দগদগে ক্ষতের মতো ঘোলা জলের ডোবা। পুকুর-নালায় মাছের কারবারিদের শ্যেন চোখের নিচে, নদীর বুকে সেই সদ্য খোঁড়া পুকুরে রুইচারা আর পার্শে-আড়ের নিভৃত কারবার। আর শেয়ালমারি?
আসরাফুদ্দিন বলেন, ‘‘শরীরে এমনই ছোট-ছোট ক্ষত নিয়ে রাতের আঁধারে যেন লুকিয়ে কাঁদে শেয়ালমারি!’’
কী রোগ তার?
ভৈরবের শাখা নদী শেয়ালমারি জুড়ানপুর থেকে বেরিয়ে প্রায় পঞ্চান্ন কিলোমিটার বয়ে পড়েছে জলঙ্গিতে। কিন্তু স্থানীয় গ্রামবাসীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, বছর দশেক ধরে সে নদী ক্রমেই আসছিল মজে। বাম আমলে সেই স্রোতহারা নদী সংস্কার না করে উল্টে নদীর জমিতেই পাট্টা দেওয়া শুরু করে স্থানীয় পঞ্চায়েত। আর তার জেরেই, বছর পাঁচেক আগে রায়পুর পঞায়েত এলাকায় কার্যত স্রোত হারিয়ে ফেলে শেয়ালমারি।
প্রায় রাতারাতি দখলদারি শুরু সেই সময়েই। আধ-মজা নদী সংস্কার না করে, বরং তার বুকে ফুট বিশেকের পুকুর খুঁড়ে শুরু করে মাছ-চাষ, কোথাও বা আবাদ।
এই নব্য আবাদি আর মাছের কারবারিদের সঙ্গে সংঘাত বেধেছে নদীতে পাট পচানো চাষিদের।
কুপিলা গ্রামের এক চাষির কথায়, ‘‘আমরা প্রতি বছর নদীতে পাট পচাই। কিন্তু দিনে দিনে যা অবস্থা হচ্ছে এ বার পাট পচাব কোথায়!’’ কোনও পাকা পুকুরে (পরিস্কার জলের পুকুর) পাট পচালে মাছ মরবে।
পুকুরের ইজারাদার যাঁরা তারা সে কাজে বাধা দেবেন। তা হলে পাট চাষিরা যাবেন কোথায়?
এ সমস্যার সমাধান না হলে আরও বড় সঙ্কট অপেক্ষা করে আছে ডোমকলে। ভাতচালা, ডুমুরতলা, শীতলনগর কিংবা রায়পুরের মতো গ্রামগুলির পাট চাষিরা তা জানেন। তাঁরা দেখছেন, নদীর কূল থেকে দেখে, চেনা নদীটা কীভাবে হারিয়ে যাচ্ছে পুকুরের গ্রাসে।
রায়পুর পঞ্চায়েত সমিতির প্রধান, কংগ্রেসের প্রদীপ চাকি বলেন, ‘‘এটা ঠিক, শেয়ালমারি নদীর বুকে পাট্টা দেওয়ার সূত্রপাত বাম আমলে। তবে, গত পাঁচ বছরে নদীর দখল বেড়েছে অনেক বেশি।’’ শেয়ালমারি দখল হয়ে যাওয়ায় ডোমকল শহরটাও যে তার নিকাশি ব্যবস্থা হারাতে বসেছে মেনে নিচ্ছেন তিনি। এ ব্যাপারে অচিরেই স্থানীয় ব্লক প্রশাসনের সঙ্গে তাঁদের বৈঠকের কথাও জানান প্রদীপ।
ডোমকলের বিডিও সোয়াং গ্যাটসো ভুটিয়াও মেনে নিচ্ছেন ‘‘এ ভাবে একটা আস্ত নদী তার গতি হারিযে ফেলবে, এটা হয় না। স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলোক বলা হয়েছে, পাট্টা দেওয়া বন্ধ রাখুন। বরং দখল হয়ে যাওয়া এলাকায় পুকুরগুলো বুজিয়ে ফের নদীকে তার স্বাভাবিক চেহারায় ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সামনের মাসেই বৈঠক ডাকা হচ্ছে।’’
কিন্তু কাজটা কি অত সহজ হবে?
রায়পুরের সফিকুল ইসলাম আগাম হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখছেন, ‘‘একবার পাট্টা দেওয়ার পরে জমি আমার। সেখানে আমি কী করব তার উপরে প্রশাসন খবরদারি করলেই হল!’’ ডুমুরতলার অন্য এক পাট্টাদার বলছেন, ‘‘নদীতো মজা, ওকে আবার স্রোত ফেরানো চাট্টিখানি কথা নাকি। আমি দাবি ছাড়ব না!’’
তবে ডোমকলের স্বার্থে গ্রামবাসীদের ‘গা জোয়ারি’ যে চলবে না জেলা প্রশাসন তা স্পষ্ট করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে অন্তত সরকারের সঙ্গে এক মত স্থানীয় বিধায়ক সিপিএমের আনিসুর রহমানও। তিনি বলেন, ‘‘এ নিয়ে দিন কয়েকের মধ্যেই ডোমকলে বৈঠক ডাকা হয়েছে। নদী সংস্কারের ব্যাপারে আমরা প্রশাসনের সঙ্গেই থাকব।’’রায়পুর এলাকার শেয়ালমারির পাশেই তাঁর গ্রাম। খাদেম আলি বলছেন, ‘‘চোখের সামনে নদীটা যে ভাবে পুকুররে গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে তাতে বড়জোর আর দু-তিনটে বছর। তার পরে এখানে আবাদ হবে।’’ আর সেই নব্য আবাদি জমির বদলে শহর ডোমকল হারাবে তাদের নিকাশি ব্যবস্থা। সে সমস্যা সামাল দেবে কে?
ছবি: সাফিউল্লা ইসলাম
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy