Advertisement
০৯ মে ২০২৪

সীমান্তেও কাঁটা পড়ল যমদুয়ারে

কারও ঠিকানা ছোট থেকেই অনাথ আশ্রম। সারা বছর বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। কেউ আবার ভিন মুলুক থেকে এসে পড়ে রয়েছেন সীমান্তে। উৎসবেও ছেদ পড়ে না দায়িত্বে। ভাইফোঁটার দিন ওঁদের সকলেরই মন পড়ে থাকে বাড়িতে। বোনের হাতে ফোঁটা নিতে না পারার যন্ত্রনা ভোগ করতে হয় এই দূর প্রান্তে বসে।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫৯
Share: Save:

কারও ঠিকানা ছোট থেকেই অনাথ আশ্রম। সারা বছর বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। কেউ আবার ভিন মুলুক থেকে এসে পড়ে রয়েছেন সীমান্তে। উৎসবেও ছেদ পড়ে না দায়িত্বে। ভাইফোঁটার দিন ওঁদের সকলেরই মন পড়ে থাকে বাড়িতে। বোনের হাতে ফোঁটা নিতে না পারার যন্ত্রনা ভোগ করতে হয় এই দূর প্রান্তে বসে।

অবশ্য এ বছর পড়াশোনা বা কর্মসূত্রে বাইরে থাকে পরিযায়ী এই মানুষদের কষ্টটা ছিল অনেকটাই কম। ভিন মুলুকের ‘বোনেদের’ দেওয়া ফোঁটা সেই কষ্টে প্রলেপ দিয়েছে। মঙ্গলবার নদিয়ার সীমান্ত লাগোয়া জনপদ করিমপুর, সদর শহর কৃষ্ণনগরে অনেকেই কপালে ফোঁটা উঠল। এলাকার ‘বোনেদের’ মাধ্যমে। ফলে এ দিনটা বেশ ভালই কাটল সীমান্তের বিএসএফ, শঙ্কর মিশনের অনাথ শিশু ও ভাটা শ্রমিকদের শিশুদের।

মিশন পাড়ার কয়েকজন যুবতী এ দিন সকালে চলে আসেন মিশনে। কারণ, এই মিশনের এই ‘ভাই’-রা যে সারা বছর এ দিনটার জন্য অপেক্ষা করে থাকে। পরিবার থেকে বহু দূরে থাকা এই শিশুদের কাছে দিদি বলতে তো ওঁরাই।

ভাইফোঁটার দিনে তাই দিদিরাও পরম যত্নে ভাইদের কপালে এঁকে দেয় মাঙ্গলিক ফোঁটা। অনাথ আশ্রম সকাল থেকেই মুখোরিত হয়ে ওঠে ভাই-বোনের খুনসুঁটিতে।

আশ্রমের আবাসিক সংখ্যা ১৭৫ জন। রীতিমতো সন্তান স্নেহে বড় হয় তারা। স্কুল ব্যাগ থেকে রঙিন জামা। বুট জুতো থেকে কম্পিউটার। সবই আছে। কিন্তু নেই কেবল পরিবার। ভাইফোঁটা এলে সেই অভাবই কিছুটা হলেও মিটিয়ে দেয় ওদের দিদিরা। আছে প্রাপ্তি ভৌমিক, দেবলিনা বিশ্বাস, প্রান্তিকা ভৌমিক, শর্মিষ্ঠা বিশ্বাসদের মতো দিদিরা। তাও প্রায় দশ বছর ধরে। একে একে ভাইদের কপালে ফোঁটা দেয় দিদিরা। তারপর মিষ্টিমুখ। সঙ্গে লুচি আর ছোলার ডাল। চেটেপুটে খায় সকলে। দেবলিনা বলে, “কে বলেছে আমার ভাই নেই। এদের দেখে কি তাই মনে হচ্ছে? এদের জন্যই ভাইয়ের অভাব বোধ করি না।”

তাই তো সময় পেলেই দিদিরা ছুটে আসে মিশনে। গল্প করে। অংশ নেয় খেলায়। প্রায় ২০ বছর ধরে এই আশ্রমে আছে গনেশ সিংহ। বাড়ির কথা তেমন মনে পরে না। তবুও ভাই ফোঁটার দিনে মনের কোনায় কোথায় যেন একটা যন্ত্রণা অনুভব করত সে। কিন্তু সেই যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে এই বোনগুলো। মিশনের পরিচালন সমিতির সম্পাদক শঙ্করশুদ্ধ চৈতণ্য মহারাজ বলেন, “এই দিনটার দিকেই ওরা সারা বছর তাকিয়ে থাকে।’’

সীমান্তের বিএসএফ জাওয়ানদের ফোঁটা দিলেন এলাকার বোনেরা। ফোটার সঙ্গে বোনেদের দেওয়া তেহট্টের ভাটুপাড়া ও লালবাজার ক্যাম্পের ৮০ জন জওয়ানকে ফোঁটা দেয় এলাকার জনা পনেরো মহিলা। লিসা মণ্ডলের কথায়, “জওয়ানেরা নিরাপত্তার স্বার্থে পরিবার থেকে বহু দূরে এসে দেশ রক্ষার কাজ করেন। অনেকেই এই সময় তাদের বাড়িতে যেতে পারেন না। তাই এমন দিনে তাদের ফোঁটা দিয়ে বরণ করলাম।” ভাইফোঁটার উদ্যোগ নেন বেতাই-১ পঞ্চায়েতের প্রধান দেবী সেন। বিএসএফের ভাটুপাড়া ক্যাম্পের অ্যাসিস্ট্যান্ট কমান্ড্যান্ট পিএস মিনা বলেন, ‘‘এই অনুষ্ঠানের কথা পরিবারকে জানিয়েছেন জওয়ানরা। পরিবার জানবে সীমান্তে আমরা একা নয়।’’

চাপড়ার মানব কল্যাণ সংস্থা বড় আন্দুলিয়া শিশু শ্রমিক আবাসিক স্কুলে আয়োজন করেছিল ভাইফোঁটার। বিকেল তারা ন’মাইলের একটি ইটভাটাতেও ভাইফোঁটার আয়োজন করেন। সংস্থার সম্পাদক দেবদুলাল বিশ্বাস বলেন, “এমন অনেককেই পেলাম যারা জীবনে প্রথম ফোঁটা নিলেন। তাদের জন্য এই ভাইফোঁটার আয়োজন করতে পেরে আমরা ধন্য।” এছাড়াও শান্তিপুরের এলাকায় গন ভাইফোঁটার আয়োজন করেছিল নদিয়া যুববার্তা।

কেউবা খালি গায়ে, গায়ে লেগে রয়েছে কাদা। কেউবা শরীরে ছেঁড়া জামাটা গলিয়ে ভাইফোটা নিতে লাইন দিয়ে বসে পড়েছে। আর তাদের কপালে ফোঁটা দিয়ে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে দুই খুদে দিদি-বোন। কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণির একটি ইটভাটায় এমন চিত্র দেখা গেল এ দিন দুপুরে। বছর চারেকের সুজন রায় থেকে শুরু করে টিংকু রায় কিংবা সঞ্জিত রায়রা খুদে দিদি ডেলভি সাহা এবং খুদে বোন লিসা চন্দর কাছে থেকে ভাইফোটার পাশাপাশি মিষ্টি পেয়ে খুশি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Bhai fota
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE