বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর বাড়ির নাটমন্দির। ছবি:সুদীপ ভট্টাচার্য।
শ্রীহট্টের রাজা দিব্যসিংহের প্রাসাদে প্রবেশ করতে হলে প্রথমেই নজরে আসে এক বিরাট কালী মূর্তি। পথাগ্রে দণ্ডায়মান সেই দেবীকে প্রণিপাত করে তবে রাজ সন্দর্শনে যাওয়াই শ্রীহট্টের প্রথা। বছরের পর বছর সেই নিয়মই চলে আসছে। কিন্তু দ্বাদশবর্ষীয় এক ব্রাহ্মণ বালক সে দিন বেঁকে বসেছে। সে কিছুতেই কালীমূর্তি কে প্রণাম করবে না। বালক আবার যে সে ঘরের সন্তান নয়। খোদ রাজপণ্ডিত কুবের মিশ্রের ছেলে। বাবার সঙ্গে রাজদর্শনে এসেছে বালক কমলাক্ষ। কিন্তু তা বলে কালী মূর্তি কিছুতেই প্রণাম করবে না। কষ্ঠি পাথরের প্রকাণ্ড দেবী মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে শুরু হল পিতার সঙ্গে বালকের যুক্তির লড়াই। শুনে স্বয়ং রাজা দিব্যসিংহ পর্যন্ত হাজির।
বালকের বক্তব্য, আমরা ব্রাহ্মণ বিষ্ণুর উপাসক। বৃক্ষমূলে জল সিঞ্চন করলেই গাছের ডালপালা পল্লবিত হয়। আলাদা ভাবে প্রতিটি ডালে পাতায় যেমন জল দিতে হয় না। তেমনি বিষ্ণু থেকেই সকল দেবদেবীর উদ্ভব। তাঁর আরাধনা করলে পৃথক ভাবে অন্য দেবদেবীকে প্রণাম করার প্রয়োজন হয় না। অকাট্য যুক্তিতে চুপ পন্ডিত কুবের মিশ্র। রাজার সামনে অস্বস্তি কাটাতে তিনি বলেন বেশ, কিন্তু পিতামাতা সকলের পরম গুরু। সেই গুরু হিসাবে আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি তুমি দেবী কালিকার এই মূর্তিকে প্রণাম কর। পিতৃ আজ্ঞা মেনে নিয়ে বালক দেবী মূর্তিকে প্রণাম করতে তৎক্ষণাৎ বিকট দ্বিখণ্ডিত হয়ে ভেঙে গেল সেই কালী মূর্তি। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত রাজা। অধোবদন কুবের মিশ্র। জনশ্রুতি, ওই বালক ছিলেন মহাদেবের অংশ। স্বামীর প্রণামে লজ্জিত হয়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে ছিলেন দেবী কালিকা।
এরপর ক্ষুব্ধ বালক কমলাক্ষ মিশ্র আর পিতৃগৃহে ফেরেননি। তিনি সোজা চলে আসেন তাঁর পিতামহ নৃসিংহপ্রসাদ মিশ্রের আশ্রয়ে নদিয়ার শান্তিপুরে। আর একটি মত হল, তিনি চলে এসেছিলেন নবদ্বীপে। সেখান থেকে পরে চলে যান পাশেই শান্তিপুরে। ওই বালকই পরবর্তী কালের বৈষ্ণব চূড়ামণি শ্রীঅদ্বৈত আচার্য। তিনি সদাশিব। ভক্তদের কাছে তিনি মহাদেবের অবতার। তাঁরই আহ্বানে সাড়া দিয়ে স্বয়ং বিষ্ণুর ‘চৈতন্যরূপে’ আবির্ভাব। শ্রীপাট শান্তিপুর তাঁর সাধনক্ষেত্র। সারা বিশ্বের বৈষ্ণব সমাজের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ভূমি।
এই কাহিনি অদ্বৈতাচার্যের বিরাট প্রতিষ্ঠারই প্রতিফলন। কেননা, ইতিহাসবিদদের ধারণা, অদ্বৈতর আমলে কালীর এমন জনপ্রিয়তা ছিল না। খোদ মহাভারতে কালির উল্লেখ রয়েছে, সপ্তম শতকেও পুরাণে কালীর কথা রয়েছে। কিন্তু তারপরেও কালী দেবী হিসেবে পঞ্চদশ শতকে এমন প্রতিষ্ঠিত ছিলেন না, যে তাঁর বিরাট মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই কাহিনি তাই অদ্বৈত এবং চৈতন্যের আন্দোলনের পরে গঠিত হওয়া বৈষ্ণবদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠারই চেষ্টা বলে মনে করা হয়। অদ্বৈতাচার্য মানেই ইতিহাস এবং কাহিনি, কিংবদন্তীর আশ্চর্য এক মেলবন্ধন। তাঁকে নিয়ে বৈষ্ণব সমাজে অসংখ্য কাহিনি প্রচলিত। অনেক ক্ষেত্রেই তার কোন পাথুরে প্রমাণও নেই।
কিন্তু তিনি যে শান্তিপুরের ভূমিপুত্র ছিলেন না সে কথা ইতিহাস স্বীকৃত। আদতে তিনি শ্রীহট্টের মানুষ। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের শ্রীহট্টের লাউর পরগনায়। পূর্বাশ্রমে নাম ছিল কমলাক্ষ মিশ্র। সময়টা ৮৪০ বঙ্গাব্দের মাঘী সপ্তমী তিথি। পিতা কুবের মিশ্র ছিলেন নবগ্রামের রাজা দিব্যসিংহের সভাপণ্ডিত। কিন্তু সেখান থেকে কী ভাবে শান্তিপুরের এলেন? কবে এলেন? তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কিন্তু আরও একটি বিষয়ে পণ্ডিতেরা এক মত, শান্তিপুর গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠার পিছনে মূল ভুমিকা ছিল অদ্বৈতাচার্যের। পরবর্তীতে তাঁর উত্তর পুরুষদের হাত ধরে শান্তিপুরের সেই ট্র্যাডিশন আজও বয়ে চলেছে।
সেই যে বারো বছর বয়সে কমলাক্ষ চলে এলেন শান্তিপুরে তারপর সুদীর্ঘ জীবনের বড় অংশই কেটেছে শান্তিপুরে। কথিত আছে শ্রীঅদ্বৈতাচার্য ১২৫ বছর জীবিত ছিলেন। তাঁর ছয় পুত্র। অচ্যুতানন্দ, কৃষ্ণ, গোপাল, স্বরূপ, জগদীশ এবং বলরাম মিশ্র। বলরাম মিশ্রের দশ পুত্র। তাঁর মধ্যে ষষ্ঠ হলেন মথুরেশ। এই মথুরেশ ছিলেন প্রখ্যাত নৈয়ায়িক। তাঁর হাত ধরে শান্তিপুরে শাস্ত্রচর্চা নতুন ভাবে প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। ন্যায়ের পণ্ডিত মথুরেশ ছিলেন অত্যন্ত দূরদৃষ্টি সম্পন্ন। তাঁর তিন পুত্র। রাঘবেন্দ্র, ঘনশ্যাম এবং রামেশ্বর। অদ্বৈতাচার্যের জীবিত কালেই নিজ পুত্রদের পৃথক করে দিয়ে ছিলেন মথুরেশ। শান্তিপুরের বিভিন্ন এলাকায় তাদের বসবাসের ব্যবস্থা হয়। বড়পুত্র রাঘবেন্দ্র থেকেই বড় গোস্বামী শাখার সৃষ্টি।
আবার কাহিনির আশ্রয়ে ফেরা। ১৫৮০ সালের কথা। মানসিংহ বাংলা আক্রমন করছেন। বারো ভুঁইয়ার অন্যতম যশোরের বসন্ত রায়ের বাড়িতে তখন পূজিত হচ্ছেন কষ্ঠিপাথরের এক অপরূপ কৃষ্ণবিগ্রহ। উৎকলীয় ভাস্কর্যের অপূর্ব নিদর্শন সেই বিগ্রহ নাকি অতীতে পুরীর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের গৃহে দোলগোবিন্দ নামে পূজিত হতেন। মানসিংহ বাংলা আক্রমণ করলে তাঁর বিধর্মী সৈন্যদের হাতে ওই বিগ্রহের পবিত্রতা নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় তৎকালীন বারো ভুঁইয়ার বংশধরেরা সেই মূর্তি তুলে দেন গুরুদেব অদ্বৈতাচার্যের পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর হাতে। তিনি সেই বিগ্রহ শান্তিপুরে নিয়ে এসে রাধারমণ নামে প্রতিষ্ঠা করেন বড় গোস্বামী বাড়িতে।
এই রাধারমণকে ঘিরেই শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির যাবতীয় উৎসব, অনুষ্ঠান, কর্মকাণ্ড আবর্তিত। এ প্রসঙ্গে বড় গোস্বামী বাড়ির তরফে সত্যনারায়ণ গোস্বামী জানান, প্রথমে রাধারমণ একাই পূজিত হতেন। কেননা, মথুরেশ যে সময়ে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন সে সময়ে বঙ্গদেশে একক কৃষ্ণমূর্তি পূজারই চল ছিল। রাধারানির আগমন অনেক পড়ে। সেখানেও ফের কাহিনির ঘনঘটা। সে কাহিনি ক্রমশ প্রকাশ্য। আপাতত এইটুকুই উল্লেখ্য রাধারমণের রাধিকা বলে মূর্তির নাম হয় ‘শ্রীমতী’। মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এক রাসপূর্ণিমা তিথিতে। তারপর থেকেই শান্তিপুরের রাস উৎসবের আড়ম্বর শুরু হয়। পরবর্তীতে সেই উৎসব ছড়িয়ে পড়ে অন্য গোস্বামী বাড়িতে। আর এখন শান্তিপুরের দেশজোড়া পরিচিতি রাস উৎসবের জন্য। যার পোশাকি নাম ভাঙা রাস। সাল তারিখের তেমন কোনও প্রামাণ্য নথি না থাকলেও বড় গোস্বামী পরিবারের দাবি এই ঘটনা প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের আগেকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy