Advertisement
০১ মে ২০২৪
নোটের গুঁতো

ছেলের টাকা না আসায় বন্ধ চিকিৎসা

ক’দিন ধরেই দরজায় আর কড়া নাড়ে না গাঁয়ের ডাক-পিওন। মোটরবাইক থামিয়ে কেউ জিজ্ঞাসাও করে না, ‘‘ও চাচা, ওসমান টাকা পাঠিয়েছে। যাবে নাকি ব্যাঙ্কে?’’ ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়া ছেলের নিয়ম করে ফোন আসছে ঠিকই।

সুজাউদ্দিন সামসুদ্দিন বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:৪৯
Share: Save:

ক’দিন ধরেই দরজায় আর কড়া নাড়ে না গাঁয়ের ডাক-পিওন।

মোটরবাইক থামিয়ে কেউ জিজ্ঞাসাও করে না, ‘‘ও চাচা, ওসমান টাকা পাঠিয়েছে। যাবে নাকি ব্যাঙ্কে?’’

ভিন্ রাজ্যে কাজে যাওয়া ছেলের নিয়ম করে ফোন আসছে ঠিকই। কিন্তু ও প্রান্তের গলাটা বেশ ভারী, ‘‘আম্মু, আর ক’টা দিন হাওলাত (ধার) করে চালাতে পারবে না?’’

ফোন রাখতেই কাশির দমক বাড়ে কুপিলার রাসেদা বিবির। প্রায় এক বছর ধরে সারা শরীরে অসহ্য যন্ত্রণা আর কাশি। মাস দেড়েক আগে বহরমপুরের এক চিকিৎসককে দেখিয়ে একটু কমেছিল। কিন্তু ক’দিন থেকে ওষুধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবার যে কে সেই।

রাসেদার স্বামী সাজাহান শেখ জানাচ্ছেন, ছেলে কেরলে থাকে। প্রতি মাসে ওঁর পাঠানো টাকাতেই সংসার চলে। কিন্তু নোট বাতিলের গেরোয় ছেলে আর টাকা পাঠাতে পারছেন না। ওই বৃদ্ধ বলছেন, ‘‘দোকান-বাজার সব তো ধারেই চলছে। কিন্তু চিকিৎসাটা তো আর ধারে হবে না। বিবির এই কষ্ট আর সহ্য করা যাচ্ছে না।’’

১৬ বছর কেরলে রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন রাজাপুরের সুশান্ত পাল। পনেরো দিন অন্তর তিনি ব্যাঙ্কে টাকা জমা দেন। বাড়ির লোকজন সেই টাকা ব্যাঙ্ক অথবা এটিএম কাউন্টার থেকে তুলে নেন। সুশান্ত কেরলের ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিচ্ছেন। কিন্তু সে টাকা তুলতে পারছেন না ওই যুবকের বাড়ির লোকজন।

সুশান্তর স্ত্রী সুষমা বলছেন, ‘‘কী বিপদে পড়লাম বলুন তো! ছেলের টিউশন ফি, হাট-বাজারের খরচা কী ভাবে মেটাব বুঝতে পারছি না। সম্প্রতি আমার সুগার ও হার্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফের যে ডাক্তারের কাছে যাব সে উপায়ও নেই।’’

নোট বাতিলের জেরে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের সীমান্ত ঘেঁষা জনপদে এমন বহু রাসেদা, সুষমারা বিপাকে পড়েছেন। দুই জেলা থেকে কর্মসূত্রে কেরল, দিল্লি, পুণে, মুম্বই, গোয়া কিংবা জয়পুরে কাজ করেন এণন লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ইরাক, দুবাই, ওমানের মতো মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতেও অনেকে কাজ করেন। তাঁরা কেউ নির্মাণ শ্রমিক, কেউ সোনার দোকানে, কেউ হোটেলে কাজ করেন।

তাঁদের পাঠানো টাকাতেই বৃদ্ধ বাবা-মায়ের চিকিৎসা হয়। পুজো-পরবে নতুন পোশাক হয়। ছেলেমেয়েরা টিউশন নেয়। পাকা হয় বাড়ি। বাড়ির লোকজন প্রথমে ভেবেছিলেন, কিছু দিন পরেই হয়তো সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু দিনের পর দিন ব্যাঙ্ক ও এটিএমের হতশ্রী চেহারা দেখে তাঁরা এখন কী করবেন, বুঝতে পারছেন না।

কর্মসূত্রে যাঁরা বাইরে যান তাঁদের অনেকেরই নিজস্ব কোনও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। এতদিন তাঁরা বাড়িতে টাকা পাঠাতেন ঠিকাদারদের মাধ্যমে। ঠিকাদাররা নিজেদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সেই টাকা পাঠিয়ে দিতেন শ্রমিকদের দেশের বাড়িতে। এখন সেটা করতে গিয়ে ঠিকাদারদের নানা সমস্যা ও প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। ভিন রাজ্যের ব্যাঙ্কগুলোও জানিয়ে দিয়েছে, টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নিজেদের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে। ফলে টাকা উপায় করেও সে টাকা বাড়িতে পাঠাতে পারছেন না শ্রমিকেরা।

আবার যাঁদের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট রয়েছে তাঁরা নিয়ম করে ব্যাঙ্ক কিংবা ডাকঘরে টাকা পাঠাচ্ছেন। কিন্তু ব্যাঙ্ক ও ডাকঘরে গিয়েও প্রাপ্তি বলতে সেই নেই নেই আর ভোগান্তি। নিট ফল, টাকার জন্য হাহাকার ক্রমে বেড়েই চলেছে। করিমপুরের কৈলাশনগরের সঞ্জয় মণ্ডল এক বছর আগে কেরলে গিয়েছেন। তিনিও প্রতি মাসে বাড়িতে টাকা পাঠান। কিন্তু এ মাসে বাড়িতে টাকা আসেনি। সঞ্জয় বলছেন, ‘‘মাসের ১০ কিংবা ১২ তারিখের মধ্যে টাকা পাঠাই। কিন্তু তারআগেই তো পাঁচশো ও এক হাজার টাকার নোট বাতিল হয়ে গেল। ঠিকাদারও সব টাকা দিতে পারেনি। যেটুকু পেয়েছি তাতে আমার প্রয়োজনই মিটবে না। ফলে এ মাসে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারিনি। সামনে মাসে কী হবে কে জানে!’’

কৃষ্ণনগর ২ ব্লকের আনন্দনগরের প্রবীর শর্মা থাকেন গোয়াতে। বাড়িতে বাবা-মা দু’জনেই অসুস্থ। এখনও তাঁরা ছেলের টাকা আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন। ডোমকলের টুনুয়ারা বিবির ছেলে কেরলে থাকে। তাঁর পাঠানো টাকা জমিয়ে এই সে দিন ঘরটা পাকা করেছেন ওই মহিলা। কিন্তু সিমেন্টের দোকানে কিছুটা ধার হয়েছিল। নভেম্বরের শেষে বকেয়া টাকাটা দেওয়ার কথা ছিল। টুনুয়ারা বলছেন, ‘‘কিন্তু ছেলে এ মাসে টাকা পাঠাতে পারেনি। এখন দোকানদার প্রায় রোজই তাগাদা দিচ্ছে।’’ কেরল থেকে ফোনে লালন শেখ বলছেন, ‘‘স্থানীয় ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য গিয়েছিলাম। কিন্তু তাঁরা যা নথিপত্র চেয়েছে তার বেশির ভাগ কাগজই তো বাড়িতে। বাবা মা ধার করেই সংসার চালাচ্ছে। ভাবছি কিছু নগদ টাকা সঙ্গে করে বাড়ি যাব। তারপর ফিরে এসেই অ্যাকাউন্ট খুলব। এখন যা পরিস্থিতি নিজের অ্যাকাউন্ট না খুলতে পারলে বাড়িতে টাকা পাঠানো যাবে না।’’ ছেলের টাকা আসার অপেক্ষায় দিন গুনছেন মসিমপুরের হেয়াতন বেওয়াও। মাস দু’য়েক থেকে চোখেও তিনি কম দেখছেন। ডাক্তার দেখিয়েছেন? হায়াতুন বলছেন, ‘‘আর ডাক্তার! আগে দু’মুঠো অন্নের ব্যবস্থা হোক। তারপরে ও সব ভাবা যাবে। টাকার কথা ভাবতে ভাবতেই তো চারদিক অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Demonetisation treatment mother
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE