—প্রতীকী ছবি।
অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীটির বয়স প্রায় ১৪ বছর। দিনমজুর বাবা তার জন্য ‘উপযুক্ত’ পাত্র দেখে বিয়ের ঠিক করেছেন। আয়োজন শেষ। খবরটা কানে এল চাইল্ড লাইনের। স্থানীয় থানার পুলিশ ও ব্লকের কর্মীদের নিয়ে তারা হাজির ছাত্রীর বাড়ি। তাদের দেখে কার্যত মারমুখী হয়ে উঠলেন পরিবারের লোকজন ও প্রতিবেশীরা। কোনও ভাবেই বিয়ে বন্ধ করতে রাজি নন তাঁরা।
অনেক চেষ্টার পর বাড়ির লোকজনকে বুঝিয়ে রাজি করানো গেল। বন্ধ হল বিয়ে। মেয়েটির বাবা-মায়ের কাছ থেকে মুচলেকা লিখিয়ে নেওয়া হল। ঘটনা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। দু’দিন পর মেয়েটিকে এক আত্মীয়ের বাড়িতে ‘বেড়াতে’ নিয়ে যাওয়া হল। মেয়েটি গ্রামে ফিরল প্রায় দেড় বছর পরে। মাস দুয়েকের সন্তান কোলে।
এমন ঘটনার সাক্ষী চাপড়ার সীমান্ত সংলগ্ন এক গ্রাম। শুধু ওই মেয়েটির ক্ষেত্রেই নয়, এমন ঘটনা হামেশাই ঘটছে নদিয়া জেলা জুড়ে। প্রশাসন গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়ে এলেও পরে আবার সেই একই পাত্রের সঙ্গে অন্যত্র লুকিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের অভিযোগ। যে কারণে বিভিন্ন মহল থেকে অভিযোগ ওঠে যে, একে সব নাবালিকা বিয়ের খবর প্রশাসন পর্যন্ত এসে পোঁছয় না, যদিও বা পৌঁছয়, সেই বিয়ে বন্ধ করে চলে আসার পর আর সে ভাবে খোঁজখবর রাখা হয় না। আর সেই সুযোগেই প্রশাসনের চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে বিয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে।
তবে পুলিশ-প্রশাসনের তরফে অনেক ক্ষেত্রেই দাবি করা হয় যে নাবালিকা বিয়ের অন্যতম কারণ ‘পালিয়ে বিয়ে’। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত প্রশাসনের কর্তাদের মতে, নাবালিকাদের প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। সেই কারণে হাজার চেষ্টা করেও নাবালিকা বিয়ে পুরোপুরি আটকানো যাচ্ছে না। প্রশ্ন হল, সে ক্ষেত্রে নাবালিকার পরিবারের তরফে খবর পাওয়ার পর পুলিশ কেন তাদের উদ্ধার করে আনছে না? যে পুলিশ বাঘা-বাঘা অপরাধীদের অন্য রাজ্য থেকে গ্রেফতার করে আনতে পারে, সেই পুলিশ কেন সামান্য দু’টি নাবালক-নাবালিকাকে উদ্ধার করতে পারে না? নাকি, এ ক্ষেত্রে পুলিশ তেমন উদ্যোগীই হয় না? অনেক সময়ই কিন্তু ‘নিখোঁজ’ নাবালিকার বাবা-মায়ের কাছ থেকে অভিযোগ আসে যে পুলিশ তাঁদের মেয়েকে উদ্ধার করার জন্য গা করছে না।
তা ছাড়া, কোনও নাবালিকা যখন পালিয়ে বিয়ে করে তখন ধরেই নিতে হবে যে তার মধ্যে সচেতনতার অভাব আছে। তা হলে কি মেয়েদের সচেতন করার ক্ষেত্রে কোনও ঘাটতি থেকে যাচ্ছে? যাঁদের উপর এই দায়িত্ব, তাঁদের কি কর্তব্যে গাফিলতি থেকে যাচ্ছে? স্কুলে-স্কুলে কন্যাশ্রী ক্লাব করেই বা তা হলে কী লাভ হচ্ছে? কন্যাশ্রী ক্লাবের পাশাপাশি ব্লক থেকে শুরু করে গ্রাম পঞ্চায়েত ও বুথ স্তরে প্রশাসনের কর্মী, জনপ্রতিনিধি ও পড়ুয়াদের নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘শিশু সুরক্ষা কমিটি’। এ ছাড়াও প্রতিটি ব্লকে চার-পাঁচ জন করে ‘ডিস্টিক্ট লেভেল রিসোর্স পার্সন’ নিয়োগ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের কর্তাদের দাবি, এঁদের পাশাপাশি অঙ্গনওয়াড়ি ও আশা কর্মীদেরও যুক্ত করা হচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ইমাম ও পুরোহিতদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে।
তা হলে, এত আয়োজনের পরেও কী ভাবে এত সংখ্যক নাবালিকার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে? কী ভাবে প্রতি মাসে শ’য়ে-শ’য়ে নাবালিকা অন্তঃসত্ত্বা হচ্ছে? সন্তান প্রসব করছে? কেন এত নাবালিকা সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা যাচ্ছে? তাহলে কোথাও ‘গোড়ায় গলদ’ রয়ে যাচ্ছে? শুধু মাত্র প্রচার চালিয়ে আর বাবা-মাকে মুচলেকা লিখিয়েই নাবালিকা বিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি থেকে মু্ক্ত হওয়া যাবে? বিশেষ করে যে অসুখের শিকড় সমাজের এতটা গভীরে ঢুকে আছে? নাবালিকা বিয়ে বন্ধ করতে যে সমস্ত কঠোর আইন আছে তা প্রয়োগের ক্ষেত্রেই ঘাটতি থেকে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy