Advertisement
৩০ এপ্রিল ২০২৪
Murshidabad Triple Murder

জিয়াগঞ্জ হত্যাকাণ্ডে ফাঁসির নির্দেশ, কোন পথে চলেছিল হাড়হিম করা ঘটনার তদন্ত

২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর দশমীর দুপুরে জিয়াগঞ্জের লেবুবাগান এলাকায় নৃশংস ভাবে খুন হন বন্ধুপ্রকাশ পাল, তাঁর স্ত্রী বিউটি এবং তাঁদের শিশুপুত্র। সেই ঘটনায় ফাঁসির সাজা হল মূল অভিযুক্ত উৎপলের।

সপরিবার বন্ধুপ্রকাশ। —ফাইল চিত্র।

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
জিয়াগঞ্জ শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৩ ২১:৩৬
Share: Save:

দশমীর ভরদুপুরে নিজেদের বাড়িতে খুন হয়েছিলেন শিক্ষক দম্পতি ও তাঁদের আট বছরের ছেলে। ২০১৯ সালে জিয়াগঞ্জে সেই নৃশংস খুনের ঘটনায় মঙ্গলবারই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন একমাত্র অভিযুক্ত উৎপল বেহরা। বৃহস্পতিবার তাঁকে ফাঁসির সাজা শোনালেন বহরমপুরের ফার্স্ট ট্র্যাক আদালতের তৃতীয় অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক সন্তোষকুমার পাঠক।

২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর দশমীর দুপুরে জিয়াগঞ্জের লেবুবাগান এলাকায় নৃশংস ভাবে খুন হন বন্ধুপ্রকাশ পাল, তাঁর স্ত্রী বিউটি এবং তাঁদের শিশুপুত্র। সেই ঘটনায় গ্রেফতার হন উৎপল। খুনের সময় গর্ভবতী ছিলেন বিউটি। তাঁর গর্ভে আট মাসের সন্তান ছিল। দীর্ঘ তদন্তের পর ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ও ২০১ ধারায় খুন ও তথ্যপ্রমাণ লোপাটের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয় উৎপলকে। বিচারপর্বের সময় এই ঘটনাকে ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ১৭টি রায়ের কথা উল্লেখ করেছিলেন সরকারি আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার আদালত ফাঁসির সাজা শোনানোর পর তিনি বলেন, ‘‘পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে এই খুন করা হয়েছে। নবমীর দিন অনলাইনে খুনে ব্যবহৃত অস্ত্রও কিনেছিলেন উৎপল বেহরা। ফরেন্সিক ইলেক্ট্রনিক এভিডেন্স প্রযুক্তি ভীষণ সাহায্য করেছে এই মামলায়। এ ছাড়াও সিসিটিভি ফুটেজ যাতে নষ্ট না হয়, তার জন্য রাইট ব্লকার ডিভাইসও কাজে লাগানো হয়। তিন বছরের পরিশ্রম সার্থক। এই বিচারে আমরা খুব খুশি। বন্ধুপ্রকাশের ৭৫ বয়সি মা, যিনি পরিবারকে হারিয়েছিলেন, তাঁকে এই রায় দেখাতে পারাটাই আমাদের শান্তি। এটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।’’

জিয়াগঞ্জে ভয়াবহ খুনের সাত দিন পর রক্তমাখা একটি বিমার কাগজ খুনিকে ধরিয়ে দিয়েছিল। পুলিশ সূত্রে খবর, তদন্তে নেমে বন্ধুপ্রকাশের বাড়ি থেকে একটি রক্তমাখা কাগজ উদ্ধার হয়। সেই কাগজে উৎপলের নাম পাওয়া যায়। তা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের সময়েই ভেঙে পড়েন অভিযুক্ত। স্বীকার করে নেন খুনের কথা। তদন্তে পুলিশ জানতে পারে, বন্ধুপ্রকাশ বিভিন্ন অর্থলগ্নি সংস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন বিমা কোম্পানির সঙ্গেও কাজ করতেন। উৎপলও একটি বিমা করান বন্ধুপ্রকাশের কাছে। আর সেই বিমা নিয়েই যত গন্ডগোল। উৎপল রাজমিস্ত্রির কাজে মাঝে মাঝে বাইরে গেলেও, মূলত বেকার ছিলেন। বন্ধুপ্রকাশ তাঁকে দিয়ে যে বিমাটি করিয়েছিলেন, তার বাৎসরিক প্রিমিয়াম ছিল ২৪ হাজার ১৬৭ টাকা। পুলিশি জেরায় উৎপল জানিয়েছেন, বিমা করানোর পর প্রথম বারের টাকার রসিদ বন্ধুপ্রকাশ তাঁকে দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ দিন হয়ে গেলেও দ্বিতীয় প্রিমিয়ামের রসিদ আর দেননি। রসিদ চেয়ে বার বার তাগাদা দিয়েও কোনও লাভ হয়নি বলে পুলিশকে জানিয়েছেন উৎপল। উল্টে তাঁর সঙ্গে বন্ধুপ্রকাশ অভদ্র আচরণ ও গালিগালাজ করেন বলে অভিযোগ। এ সব মিলিয়ে উৎপলের সন্দেহ হয় বন্ধুপ্রকাশ আদৌ তাঁর প্রিমিয়ামের টাকা জমা দেননি। তার পরেই প্রতিশোধস্পৃহা থেকে খুন করার সিদ্ধান্ত নেন উৎপল।

জেরার সময়ে পুলিশকে উত্পল জানিয়েছেন, গত ৩ অক্টোবর বন্ধুপ্রকাশকে শেষ বার তিনি ফোন করেন। উৎপল তখন পূর্ব মেদিনীপুরের এগরায় রাজমিস্ত্রির কাজে ছিলেন। এর পর ৮ অক্টোবর অর্থাৎ খুনের দিন সকালে তিনি জিয়াগঞ্জে যান। সেখানেই তাঁর বোনের বাড়ি। পুজোর জামাকাপড় বোনের বাড়িতে দেওয়ার পর দুপুরের দিকে যান বন্ধুপ্রকাশের বাড়িতে। সঙ্গে ছিল হাঁসুয়া। পুলিশের কাছে উৎপল জানিয়েছেন, খুনের জন্য তৈরি হয়েই ওখানে গিয়েছিলেন তিনি। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় উৎপলকে দেখে ঘরের দরজা খুলে দিয়েছিলেন বন্ধুপ্রকাশ নিজে। দরজা খুলে ভিতরে ঢোকার পরেই উৎপল তাঁর গলায় হাঁসুয়ার কোপ বসিয়ে দেন। আচম্বিতে হাঁসুয়ার কোপে আহত হয়ে পাশের বিছানায় লুটিয়ে পড়েন বন্ধুপ্রকাশ। এর পর তাঁর উপর এলোপাথাড়ি হাঁসুয়ার কোপ মারে উৎপল। পাশের ঘরেই ছেলেকে নিয়ে শুয়ে ছিলেন বন্ধুপ্রকাশের স্ত্রী বিউটি। উৎপল পাশের ঘরে ঢুকে তাঁদের দু’জনকেও কুপিয়ে খুন করেন।

কী ভাবে এগোল তদন্ত? পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ খতিয়ে দেখে জানা যায়, ঘটনার দিন উৎপল যখন বন্ধুপ্রকাশের বাড়িতে ঢোকেন, তখন তাঁর পিঠে একটি কালো ব্যাগ ছিল। পরে তদন্ত চলাকালীন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা উদ্ধার হওয়া ব্যাগ থেকে একটি জং পড়া দাগ পান। তা থেকে প্রমাণ হয়, ওই ব্যাগে কোনও ধারালো অস্ত্র ছিল। সেই অস্ত্র দিয়েই প্রাথমিক শিক্ষক বন্ধুপ্রকাশকে হত্যা করা হয়। সাক্ষ্য লোপাট করতে খুন করা হয় তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও আট বছরের শিশুপুত্রকেও। খুনের পর ঘটনাস্থলেই তাঁর চটি ব্যাগ ও রক্তমাখা টি-শার্ট ফেলে রেখে গিয়েছিলেন উৎপল। তদন্তকারীরা জানান, দশমীর দিন বন্ধুপ্রকাশকে খুনের উদ্দেশ্যে নিয়েই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন অভিযুক্ত। উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও ঘরের একাধিক জায়গায় তাঁর আঙুলের ছাপ পাওয়া গিয়েছে। ঘাটের সিসি ক্যামেরা ফুটেজে দেখা গিয়েছে, ঘটনার পর ব্যাগ, টি-শার্ট ফেলে রেখে শুধু স্যান্ডো গেঞ্জি আর বারমুডা পরে ঘাট পেরিয়ে নৌকায় উঠেছেন উৎপল। ঘাট পার হওয়ার জন্য নৌকায় ওঠার আগে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন পরনে থাকা ফুলপ্যান্ট। এর পর নৌকা থেকে আজিমগঞ্জে নেমে টিশার্ট কিনে বাড়ি ফেরেন তিনি। ঘটনার ১১ নম্বর সাক্ষী শিক্ষক দম্পতির বাড়িতে দুধ বিক্রি করতে আসা গোয়ালা। দীর্ঘ ক্ষণ ডাকাডাকি করেও কোনও উত্তর না পাওয়ায় জানলা খুলে তিনি দেখেন, শিক্ষক দম্পতির নিথর দেহ পড়ে রয়েছে মেঝেতে। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আরও এক জনকে ফোন করেন। ওই দু’জনেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ঘটনাস্থল থেকে রক্তের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। উৎপল জেলে বন্দি থাকাকালীন সিসিটিভি নজরদারিতে ছিলেন। তাঁর শরীরের অঙ্গভঙ্গির ভিডিয়ো রেকর্ড করে সেই দিনের সন্দেহভাজনের অঙ্গভঙ্গি খতিয়ে দেখেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞরা। তা থেকে তাঁরা নিশ্চিত হন যে, দু’জনেই একই ব্যক্তি। উৎপলের মোবাইলের টাওয়ার লোকেশনও ঘটনার সময় বন্ধুপ্রকাশের বাড়ির আশপাশে তাঁর উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE