বহরমপুরে সিল করে দেওয়া হয়েছে পানীয় জলের কারখানা।
মুর্শিদাবাদের ২৬টা ব্লকের প্রায় সবক’টিতেই পানীয় জলে সহন সীমার অতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে। সব ব্লকেই ভূগভর্স্থ জলের স্তর দ্রুত নামছে। জেলা প্রশাসনের এই তথ্যকে ‘খুড়োর কল’ করে মুর্শিদাবাদে পরিস্রুত পানীয় জল বিক্রির ব্যবসা দীর্ঘ দিনের। পরিস্রুত পানীয় জল দাবি করে রমরমিয়ে সে বাণিজ্য চললেও, তা আদপে কতটা পরিস্রুত প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। সেই ব্যবসায় লাগাম টানতে সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের জলসম্পদ অনুসন্ধান দফতর বহরমপুর, বেলডাঙায় তল্লাশি চালায়। তারপরেই জল পরিস্রুত করে বিক্রি করা হয়— এমন তিনটি কারখানা সিল করে দেয়। কেন? দফতরের কর্তাদের দাবি, আইন না মেনে কারখানাগুলি তৈরি হয়েছে। তাই এমন সিদ্ধান্ত।
সরকারি হিসেবে, জল পরিস্রুত করে গোটা মুর্শিদাবাদে সরবরাহ করে এমন ৫০০টি কারখানা আছে। তার অধিকাংশই বেআইনি বলে দাবি প্রশাসনের। এমন কারখানার অন্তত দু’শোটি রয়েছে বহরমপুরে। জেলা সদর বহরমপুর ও সংলগ্ন এলাকা মিলিয়ে চার লক্ষ মানুষের একটা বড় অংশই সেই জল খান। জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ওয়েস্ট বেঙ্গল গ্রাউন্ড ওয়াটার রিসোর্সেস (ম্যানেজমেন্ট কন্ট্রোল এন্ড রেগুলেশেন) অ্যাক্ট ২০০৫ আইন অনুযায়ী, অনুমতি ছাড়া কেউ মাটির নীচের জল ব্যবসায়িক স্বার্থে তুলতে পারবেন না। নিয়ম হল, জলপ্রকল্প করতে গেলে আট হাজার স্কোয়ার ফুট জায়গার মধ্যে চার হাজার স্কোয়ার ফুট ‘হাইজেনিক এরিয়া’, দু’হাজার গ্রিন বেল্ট ও বাকি অংশে স্টোরেজ ও গবেষণাগার রাখতে হবে।
অভিযোগ, সে সব নিয়মের তোয়াক্কা না করেই পুলিশ প্রশাসনের নাকের ডগায় দিনের পর দিন এমনটা চলছিল। তার ফলে কমে আসছিল মাটির নীচের জল। কিন্তু, হঠাৎ করে কেন ধরপাকড়? বছরখানেক আগে এক সমীক্ষায় নজরে আসে, জেলায় জলস্তর দ্রুত নেমে যাচ্ছে। তারপরেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। নজরদারি চালানোর জন্যে প্রশাসনের কর্তা ও জন প্রতিনিধিদের নিয়ে গত ডিসেম্বরে ১৬ জনের কমিটি তৈরি গড়া হয়। ওই কমিটির প্রধান জেলাশাসক। সেই সিদ্ধান্তের কথা রাজ্যকেও জানানো হয়। তারপর প্রশাসনের টালবাহানায় অনুমোদন মিলতে মিলতে চলে আসে এ বছরের এপ্রিল মাস। তার প্রেক্ষিতে ২২ জুনের এই তল্লাশি। ওই দিন বহরমপুরের কৃষ্ণমাটি, বেলডাঙার সরুলিয়া, বেগুনবাড়ি অঞ্চলে অভিযান চালানো হয়।
ওই কমিটি সূত্রে খবর, জেলায় মাত্র দু’টো কারখানা আছে, যেখানে নিময় মেনে জল পরিস্রুত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। বাকিরা কী করে?
বৃহস্পতিবার বহরমপুর, বেলডাঙার বিস্তীর্ণ এলাকায় ঘুরে দেখা গেল, ১০০-২০০ স্কোয়ার ফুট জায়গায় কোনও রকমে একটা চালা তৈরি করে চলছে কারখানা। জল শোধনের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে খুব কম দামের পুরনো মেশিন। প্রশাসন তদন্তে জেনেছে, পুরানো মেশিন বিক্রির চক্র পিছনে থেকে এই কারখানাগুলি চালায়। চক্রের ‘টার্গেট’ থাকে বেকার, অল্প শিক্ষিত যুবক। তাঁদের চিহ্নিত করে কারখানা চালু করতে উৎসাহিত করা হয়। তারপর পঞ্চায়েত বা পুরসভার একটা অনুমোদন নিয়ে চালু হয়ে যায় ব্যাবসা। লক্ষ্য একটাই, সস্তায় পানীয় জল সরবরাহ।
এমন ভাবে পানীয় জল সরবরাহ করা যে বেআইনি প্রশাসনের তল্লাশির আগে তা জানা ছিল না বলে দাবি করেছেন বহরমপুরের কৃষ্ণমাটির ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ দাস। তিনি বলেন, ‘‘তিন বছর আগে প্রায় ছয় লক্ষ টাকা কয়েক কিস্তিতে খরচ করে প্রকল্পটি তৈরি করেছিলাম। পঞ্চায়েতের ‘ট্রেড লাইসেন্স’ নিয়েছিলাম। কিন্তু গত ২২ তারিখে প্রশাসন থেকে জানানো হয় এতে হবে না। মাটির নীচের জল যে তুলতে নেই তা জানতাম না।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘কারখানায় ৬ জন শ্রমিক ছিলেন। আমার সঙ্গে তাঁদেরও ওই কারখানা থেকে পেট চলতো। সেটা বন্ধ হয়ে গেল।’’ ওই কারখানায় ভ্যান চালাতেন গৌতম সিংহ। তাঁর কথায়, ‘‘এখন অন্য কিছু ভাবতে হবে।’’
জলসম্পদ অনুসন্ধান দফতরের জেলা ভূতত্ববিদ ঋত্বিক চট্টোপাধ্যায় জানান, রমজান মাস চলায় এখন অভিযান বন্ধ রাখা হয়েছে। কিছু দিন পরেই ফের অভিযান শুরু হবে।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy