শান্তিপুরের বড় গোস্বামী বাড়ির ঝুলন মঞ্চ। — নিজস্ব চিত্র
শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে গিয়েছে অদ্বৈতপাট শান্তিপুরের পথঘাট, বিগ্রহবাড়ি। মন্দিরময় শান্তিপুর মেতেছে ঝুলনে। সেই কবে থেকে এই শহরের প্রাচীন বিগ্রহবাড়িগুলিতে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন হয়ে আসছে। কোনও পাথুরে প্রমাণ না থাকলেও উৎসবের বয়স কয়েক’শো বছরের কম নয় বলেই দাবি শহরের মানুষের।
বড়গোস্বামী বাড়ি, হাটখোলা গোস্বামী বাড়ি, শ্যামচাঁদ মন্দির, খাঁ বাড়ি, সাহা বাড়ি, গোকুলচাঁদের বাড়ি-সহ বিভিন্ন মন্দিরে এখন সাজ সাজ রব। কোনও পুরনো নাটমন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎই কানে ভেসে আসে মল্লার কিংবা কেদারে বাঁধা কীর্তনের সুর।
তারপর শ্রাবণের শুক্লা ত্রয়োদশীর সন্ধ্যা নামলেই শহরের প্রাচীন বিগ্রহবাড়িগুলির ঝুলন মন্দিরে সাড়ম্বরে অধিষ্ঠিত হন রাধাকৃষ্ণ বিগ্রহ। ফুলের মালায় ঢাকা সিংহাসন। অগুরুচন্দনের গন্ধে ম ম করছে নাট মন্দির। কামিনী, জুঁই, বেলফুলে সাজানো দোলনায় রাধাকৃষ্ণ। ধূপের পাকিয়ে ওঠা ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে মৃদু আলোয় দেখা যাচ্ছে অপূর্ব সব মূর্তি।
সমবেত ভক্তদের জয়ধ্বনি শেষে কীর্তনিয়ার রেওয়াজি কণ্ঠে বেজে ওঠে জয়জয়ন্তীতে বাঁধা ঝুলন কীর্তনের মহাজনী পদ। সঙ্গে শ্রীখোলে ‘দশকুসি’ বা ‘চঞ্চুপুটের’ বোল। বিগ্রহের সামনে বসেছে আসর। চলছে ঝুলনলীলার গীতাভিনয়। মানুষ বুঁদ হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুনছেন, “শাঙন মাস গগনে ঘন গরজন, দীপিত দামিনী মাল, বরখত বারি, পবন মৃদু মন্দহি গঙ্গতরঙ্গ বিশাল।’’
এ ভাবেই ঝুলন উৎসব আসে অদ্বৈতপাট শান্তিপুরে। শান্তিপুর মানেই অদ্বৈতাচার্য। ইতিহাস এবং কাহিনীর আশ্চর্য এক মেলবন্ধন। তাঁকে নিয়ে বৈষ্ণব সমাজে অসংখ্য কাহিনী প্রচলিত। আদতে তিনি শ্রীহট্টের মানুষ। পূর্বাশ্রমে তাঁর নাম ছিল কমলাক্ষ মিশ্র।
শান্তিপুর গৌড়িয় বৈষ্ণবধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠার পিছনে মূল ভূমিকা ছিল অদ্বৈতাচার্যের। পরবর্তীতে তাঁর উত্তর পুরুষদের হাত ধরে শান্তিপুরের সেই ট্র্যাডিশন আজও বয়ে চলেছে। বারো মাসে তেরো পার্বণের অন্যতম একটি পার্বণ ঝুলন পূর্ণিমা।
শান্তিপুরের বিভিন্ন বিগ্রহ বাড়িগুলিতে শ্রাবণের শুক্লা ত্রয়োদশী থেকে পূর্ণিমা এই তিন দিন ধরেই চলে ঝুলন উৎসব। প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিভিন্ন বিগ্রহবাড়ির দেবতা আসেন নিজ নিজ ঝুলন মন্দিরে। অনেক রাত পর্যন্ত চলে পাঠ কীর্তন দর্শন। ‘‘কেবল পূর্ণিমায় সারাদিন ধরেই শ্রীরাধারমণ জিউ এবং শ্রীমতী থাকেন ঝুলনমন্দিরের দোলনায়। এ দিন দিনভর ভাগবত পাঠ হয়। সন্ধ্যায় ঝুলনকীর্তন।’’ বলছিলেন শান্তিপুর বড় গোস্বামী বাড়ির পরিচালন সমিতির সম্পাদক প্রদ্যুৎ গোস্বামী।
একই ভাবে উৎসবে সামিল হয় অনান্য বিগ্রহবাড়ি। শান্তিপুরের বাসিন্দা স্বপন রায় বলেন, ‘‘এক সময়ে শান্তিপুরের ঝুলনের প্রধান আকর্ষণ ছিল সঙ। ষাট বছর আগেও হাটখোলা গোস্বামী বাড়িতে পৌরাণিক নানা বিষয়ে সঙ সাজানো হত। তাদের নিয়ে জমে উঠত ঝুলনের দিনগুলি। এখন তেমনটা হয় না। তবে শান্তিপুরের বিভিন্ন পাড়ায় মানুষ ঝুলনের প্রচলন সম্ভবত সেকালের সঙ থেকেই এসেছে। এক সময়ে দারুন সারা ফেলেছিল শান্তিপুরের সেই মানুষ ঝুলন।’’
ঝুলনের সঙ্গে শান্তিপুরে মিশে আছে আরও একটি বিশেষ ঘটনা। ১২৪৮ বঙ্গাব্দে ঝুলন পূর্ণিমা তিথিতেই বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর আবির্ভাব।
উৎসবের শেষ দিনে, ঝুলন পূর্ণিমায় হাটখোলা বাড়ির গোকুলচাঁদ জিউ, বড় গোস্বামী বাড়ির রাধারমণ জিউ, খাঁ চৌধুরী বাড়ির গোপীকান্ত জিউ কিংবা সাহাবাড়ির রাধাকান্ত জিউকে ঘিরে ভক্তদের জমায়েত চোখে পড়ার মতো। বড় গোস্বামী বাড়ির তরফে সত্যনারায়ন গোস্বামী জানান, এ দিন সকাল থেকেই শুরু হয়ে যায় ভাগবত পাঠ। থাকে বিশেষ পূজা এবং ভোগরাগের আয়োজন।
দুপুরের ভোগে ষোড়শপচারে অন্নব্যাঞ্জনের আয়োজন হয়। গোবিন্দ ভোগের অন্ন শাক, শুক্ত, মোচা, ডাল, ভাজা, একাধিক সব্জি, পুষ্পান্ন, ছানার রসা, চাটনি, পরমান্ন নিবেদন করা হয় রাধাগোবিন্দের ভোগে। এলাকার মহিলারা প্রথা মেনে বাড়ি থেকে রাধারমণ এবং শ্রীমতীর জন্য শুদ্ধাচারে তৈরি করে আনেন নানা মিষ্টি, ক্ষীর, নাড়ু, মালপোয়া,গজা, নিমকির মতো খাবার।
পূজা-পাঠে, কীর্তনে-গানে, সুখাদ্য-সুগন্ধে শান্তিপুর এখন ঝুলনে মাতোয়ারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy