মেয়েদের ইফতার। রবিবার চাঁদসড়কপাড়া মাঠেরপাড়া ইদগাহ মসজিদের উদ্যোগে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।
হাতে গোনা আর কয়েকটা মাত্র দিন। তার পরই ইদ-উল-ফিতর। খুশির ইদ। কিন্তু ইদের বাজার সে খুশির ছোঁয়া কই! জিনিসপত্রের আকাশ ছোঁয়া দামে ক্রেতা-বিক্রেতা দু’তরফেই নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড়। ইফতারের ফল থেকে উৎসবের দিনের নতুন পোশাক, দাম বেড়েই চলেছে। এ বারে আবার ইদ এগিয়ে আসায় পাট এখনও জমিতে। চাষির হাতে নগদ টাকা নেই। ফলে প্রত্যাশা মতো জমছে না বাজার।
এ হেন অবস্থায় ইদের বাজারে ফুটপাথই ভরসা। শহরের বড় দোকান বা অভিজাত বিপণী নয়। সাধারণ গ্রামীণ ক্রেতা ইদের জন্য বেছে নিয়েছেন ছোট বা অস্থায়ী দোকান কিংবা ফেরিওয়ালাকে। স্থানীয় গ্রামীণ হাটের উপরই নির্ভর করছেন তাঁরা। নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগরের মতো শহরে ইদের বাজারে তাই বড় বড় দোকান ফাঁকা পড়ে থাকলেও ঠিক তার সামনে ফুটপাথে উপচে পড়ছে ভিড়।
কিন্তু কেন?
উত্তরে আকাশের দিকে আঙুল তুলছে বণিক মহল। আষাঢ়ের অর্ধেক পেরিয়ে গেলেও বর্ষা এখনও সে ভাবে আসেনি। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলেও, তা যথেষ্ট নয়। তাই রাজ্যের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট নিয়ে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। চাষিদের আশঙ্কা এ ভাবে চললে পাট পচানোর সময়ে যথেষ্ট জল নাও মিলতে পারে। বিশেষজ্ঞদেরও একসুর। তাঁদের কথায় এ বারে যে ভাবে বৃষ্টি হচ্ছে তাতে পাটগাছের বৃদ্ধি খুব ভাল হলেও, পাট পচানোর সময় জলের অভাব হওয়ার প্রবল আশঙ্কা। তা হলে কী করে হাত খুলে বাজার করবেন গ্রামের ক্রেতা?
এ রাজ্যের ব্যবসায়ীদের দু’টি প্রধান উৎসবের মরশুম হল দুর্গাপুজো আর ইদ। সারা বছরের লাভ-লোকসানের অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই দুই উৎসব। তবে ইদ আর পুজোর মধ্যে সামান্য কয়েক দিনের ফারাক থাকলে তাঁরা একই সঙ্গে দু’টি উৎসবকে মাথায় রেখে প্রস্তুতি নিতে পারেন। একই বিনিয়োগে দু’বার বাণিজ্য হয়। কিন্তু এ বার দু’টি উৎসবের মধ্যে প্রায় তিন মাসের ফারাক। ব্যবসায়ী মহলের কথায়, দু-দু’টো বড় উৎসবের জন্য আলাদা করে নগদ টাকা বিনিয়োগ করা একটু ঝুঁকির হয়ে যায়। বিশেষ করে যেখানে দু’টি উৎসবের মেজাজ দু’ধরনের। ক্রেতাদের পছন্দ অপছন্দও ভিন্ন ভিন্ন। তাই পুজোর মাস তিনেক আগে বড় মাপের বিনিয়োগে রাজী নন অনেক দোকানদারও।
বৃষ্টিতে সুনসান ইদের বাজার। কৃষ্ণনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।
‘নদিয়া ডিস্ট্রিক্ট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিস’-এর সম্পাদক গোকুলবিহারী সাহা এই বিষয়ে বলেন, “পাটের জন্য এখন বৃষ্টি খুব জরুরী। কারণ রাজ্যের প্রধান অর্থকরী ফসল পাট চাষ করে চাষি দু’পয়সার মুখ দেখলে, তা সারা রাজ্যের বাণিজ্য অর্থনীতির পক্ষেই ভাল। ইদের এই ঝিমিয়ে পড়া বাজার ব্যবসায়ীদের কাছে ভাল সংকেত দিচ্ছে না।” বণিকমহলের মতে ছোট ব্যবসায়ীরা ভাল ব্যবসা করেছেন, খুবই ভাল কথা। কিন্তু ইদের মতো উৎসবে জেলাসদরের বড় বড় দোকানে লোক নেই, আর ফুটপাতে ভিড় করে কেনাকাটা চলছে, এটা অর্থনীতির পক্ষে খুব স্বাস্থ্যকর ছবি নয়।
নবদ্বীপের রেডিমেড ব্যবসায়ী মদন ঘোষ যেমন বলেন, “অনান্য বার পুজো ইদ পাশাপাশি পড়লে যে ভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হয় এ বার তেমন হয়নি। রুচির ভিন্নতার কারনেই ইদের জিনিস পুজোয় বিক্রি হবে না। উল্টে টাকাটা আটকে যাবে।” তার মতে মুসলিম প্রধান অঞ্চলেই এখন বেশি ব্যবসা হবে। তা ছাড়া নবদ্বীপ বা কৃষ্ণনগরে ইদের নিজস্ব ক্রেতা খুব কম। পার্শ্ববর্তী এলাকার ক্রেতাদের বড় অংশ নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির। বড় দোকানে তাঁরা আসবেন না, এটাই স্বাভাবিক।
তবে ইদের বাজারে সব থেকে বড় বিপদ মূল্যবৃদ্ধি। ব্যবসায়ীদের নদিয়া জেলা সংগঠনের সম্পাদকের কথায় “অস্বাভাবিক হারে সব ধরনের জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ী সবাই দিশেহারা হয়ে পড়ছেন। মুদিখানা থেকে ফল বা অনান্য খাবার, পোশাক-পরিচ্ছদ থেকে ভোগ্যপণ্য সব কিছুরই দাম যেন আকাশ ছোঁয়া। সাধারণ ক্রেতারা, যারাই সংখ্যায় বেশি বাধ্য হচ্ছেন বাজেট কমিয়ে দিতে। যতটা না হলে নয়, ঠিক ততটুকুই কেনাকাটা করতে। এবং সেই জন্যই তাঁরা বেছে নিচ্ছেন সস্তার দোকান।”
একই সুরে জিনিসের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারন মানুষের সমস্যার কথা বলেন নদিয়ার সোনডাঙ্গার শিক্ষক সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, “রোজার মাসে খেজুর, আপেল, শসা, কলা আঙ্গুরের মতো ফল প্রতিদিন লাগে। খেজুর থেকে শসার দাম হঠাৎ করে তিন-চার গুন চড়েছে। একটা কলা চার টাকা বলছে। ৮০ টাকার খাস্তা সিমাই রোজা
শুরু হতেই ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা। এক জন স্বল্প আয়ের মানুষ কি করে মাসভর ইফতার সারবেন আর পরিবারের জন্য কি করেই বা কেনাকাটা করবেন?” ইদের দিনে খাওয়া দাওয়ার মেনুতেও এ বার কাটছাঁট করতে বাধ্য হবে অনেকেই, বলে মনে করেন তিনি। রোজা শুরু হতেই ফলের দাম কার্যত নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে সাধারনের। শসা থেকে খেজুর সব রাতারাতি দামি হয়ে গিয়েছে। ২০০ টাকার খেজুর তিনশো ছুঁই ছুঁই। রোজার মাসে ফল এবং অনান্য খাদ্যদ্রব্যের চাহিদা বেশি হওয়ায় সমস্যায় পড়ছেন ক্রেতাবিক্রেতা উভয়েই।
একই ছবি পোশাকের বাজারেও। বৃহস্পতিবার ছিল ইদের আগে নবদ্বীপ তাঁত কাপড় হাটের শেষ হাট। ফলে উপছে পড়ে গ্রামীন ক্রেতার ভিড়। ব্যবসায়ীরা জানাচ্ছেন কালনা থেকে আজিমগঞ্জ পর্যন্ত বিরাট এলাকা থেকে নবদ্বীপ তাঁত কাপড় হাটে ক্রেতারা আসেন। পাইকারি খুচরো দু ধরনের ক্রেতারাই এখানে আসেন। প্রধানত কমদামী ভালো জিনিসের জন্য নবদ্বীপ হাটের সুনাম বহুকালের। ২৫০ টাকা থেকে শুরু চুড়িদার, ৪০ টাকা থেকে ওড়না, ৮০ টাকায় লুঙ্গি। এবারে ইদের বাজারে সবচেয়ে বেশি চলছে তাঁতের কাপড়ের উপর এমব্রয়ডারি করা শাড়ি। নবদ্বীপ হাটে সেই শাড়ির পাইকারি বিক্রয় মূল্য ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। হাটের ব্যবসায়ী বাবুলাল সাহা জানান, “এখানে যে দামে যে মানের জামাকাপড় বিক্রি হয় তা অন্য কোথাও মেলে না। ফলে সালার থেকে শুরু করে সমুদ্রগড় পর্যন্ত গোটা এলাকার ছোট ব্যবসায়ী, গ্রামীণ হাটের দোকানদার থেকে ভ্রাম্যমান ফেরিওয়ালা সকলেই নবদ্বীপ হাট থেকে মাল কিনতে আসেন। যে কারণে নবদ্বীপ হাটে কেনাবেচা একটা পর্যায়ের নিচে নামে না।”
নবদ্বীপের নামী পাঞ্জাবি ব্যবসায়ী মোহন রায় বলেন, “খুব অল্প সংখ্যক হলেও আমাদের মতো দোকানে যারা আসছেন পাঞ্জাবী কিনতে সেখানে একটা জিনিস পরিষ্কার মানুষের রুচির আমুল পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। শহুরে ছোঁয়া এখন গ্রামেও। সেইসব আধুনিক ডিজাইনের জিনিসপত্রের দামও স্বাভাবিক ভাবেই বেশি। এই শ্রেণির ক্রেতারা আবার দাম নিয়ে ভাবছেন না। পছন্দ হলে দু হাজার টাকা দামের পাঞ্জাবী চোখ বুঁজে কিনে নিয়ে যাচ্ছে। তবে এরা সংখ্যায় খুবই কম।”
তবে জেলার মুসলিম প্রধান চাপড়া বা করিমপুরের ছবিটা কিছুটা হলেও অন্য রকম। স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে মাত্র এক দশকের মধ্যে ইদের মতো উৎসবে বিক্রিবাটার ধরনটা আমুল বদলে গিয়েছে। বিভিন্ন গ্রামীণ এলাকার আর্থিক কাঠামোর একটা বড়সড় বদল ঘটে গিয়েছে বাইরে কাজে যাওয়া মানুষগুলোর দৌলতে। তাঁরা এখন আর আগের মতো জিনিস কিনতে বসে দরাদরি করেন না। উল্টে দোকানে এসে প্রথমেই বলে দেন, ‘‘সব চেয়ে ভাল জিনিসটা দেবেন। দাম নিয়ে ভাববেন না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy