Advertisement
১১ মে ২০২৪
ঘুরে-ঘুরে রেকর্ড করেছেন কীর্তন, ইচ্ছে ছিল গড়ে তুলবেন লোকগানের সংগ্রহালয় আর গবেষণা কেন্দ্র

বৈশাখী পূর্ণিমায় ঘাটে বসে গেয়েই চলেছেন কালিকাপ্রসাদ

চওড়া ডায়েরির পাতায় উপরের কোণে তারিখটা জ্বলজ্বল করছে— ১৭/১১/২০১৫। নীচে কয়েকটি লাইন। টেবিলে খোলা ডায়েরি নিয়ে বসে নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব।

স্মৃতি: নবদ্বীপের শ্রীবাসঅঙ্গন ঘাটে। ছবি: সৌজন্যে সুব্রত পাল।

স্মৃতি: নবদ্বীপের শ্রীবাসঅঙ্গন ঘাটে। ছবি: সৌজন্যে সুব্রত পাল।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৭ ০২:১১
Share: Save:

চওড়া ডায়েরির পাতায় উপরের কোণে তারিখটা জ্বলজ্বল করছে— ১৭/১১/২০১৫।

নীচে কয়েকটি লাইন।

টেবিলে খোলা ডায়েরি নিয়ে বসে নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদের সম্পাদক শান্তিরঞ্জন দেব। উল্টো দিকে কাঠের চেয়ারটা দেখিয়ে বলছেন— “ওখানে বসেই দীর্ঘক্ষণ তাঁর পরিকল্পনার কথা বলেছিলেন কালিকাপ্রসাদ। সব এখন স্মৃতি।” বলতে-বলতে ভিজে চোখ দু’টি বুজে ফেলেন প্রবীণ।

কালিকাপ্রসাদ প্রথম বার নবদ্বীপে আসেন ১৯৯৯ সালে। সবে ‘দোহার’ তৈরি হয়েছে। আর ২০০৬ সালে আসেন বহরমপুর ব্যারাক স্কোয়ার ময়দানে ‘যুগাগ্নি’ নাট্যগোষ্ঠীর নগরনাট্য মেলায়। ডিসেম্বরের শীতেও খোলা আকাশের নীচে এত লোক এসেছে দেখে ভারী খুশি হয়েছিলেন। যুগাগ্নির সদস্য অনুপম ভট্টাচার্যের কথায়, শেষ আসেন গত মাসে গোরাবাজার বিজয়কুমার হাইস্কুলে। মাঝের বছরগুলোয় নিজের স্বভাবেই খুঁজে নিয়েছিলেন বহু বন্ধু।

মঙ্গলবার সকালে গুড়াপ থেকে গাড়ি দুর্ঘটনার খবরটা টিভি-ফোন-হোয়াটসঅ্যাপ বাহিত হয়ে পৌঁছতেই কার্যত বাজ পড়ে দুঃসংবাদ পাওয়ার পরে আর অফিস যেতে পারেননি অনুপম। বলেন, ‘‘বহরমপুরে এলে আমার বাড়িতে আসতেন। ওঁর বাড়িতেও যেতে বলে গেলেন গত বার।’’

২০১৪ সালের দোলে প্রথম টোটো দেখেছিল নবদ্বীপ। শহরের এক মাত্র টোটোটি রিজার্ভ করে দু’দিন ধরে ঘুরে-ঘুরে শুনলেন বসন্তকীর্তন। রেকর্ড করে রাখলেন সুমন ভট্টাচার্য থেকে সরস্বতী দাসের গায়ন। দোলের দিনগুলোয় বিভিন্ন মঠমন্দিরের নানা ঘরানার কীর্তন সংগ্রহ করতে পৌঁছে যেতেন। মণিপুর রাজবাড়ির বসন্তকীর্তনে অথবা মহাপ্রভু মন্দিরের দোল কীর্তনের আসরে ধুতি আর হলুদ পাঞ্জাবি পড়া কালিকাপ্রসাদ শিক্ষার্থীর আগ্রহে ছবি তুলছেন, দ্রুত হাতে নোট নিচ্ছেন খাতায়, এমন দৃশ্য ছিল খুব চেনা।

পরিচিতদের কাছে কালিকাপ্রসাদ বারবার বলেছিলেন, নবদ্বীপে লোকগানের সংগ্রহালয় এবং বাংলা কীর্তন গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে চান। চেয়েছিলেন, একখণ্ড জমিতে গড়ে তুলবেন তাঁর সাধের প্রতিষ্ঠান।

গত তিন বছরে বারবার এসেছেন প্রাচীন বাংলাকীর্তনের শেষ সম্রাজ্ঞী সরস্বতী দাস কিংবা সদ্যপ্রয়াত খোল বাদক চন্দ্রকান্ত কংসবণিকের বাড়িতে। দোহারের আয়োজনে প্রথম বছরের ‘সহজ’ পরবে রবীন্দ্রসদনে সংবর্ধনার কথা এখনও ভুলতে পারেন না সরস্বতী দাস। মঙ্গলবার দুর্ঘটনার খবর শোনার পরেই কান্নায় ভেঙে পড়ে আবেগপ্রবণ কীর্তনিয়া বলেন, “এক হাত কালিকা ধরেছে আর এক হাত লোপামুদ্রা। হাত এ ভাবে মাঝরাস্তায় কেন ছেড়ে দিল কালিকা?” চন্দনযাত্রা নবদ্বীপের অন্যতম এক কীর্তনপ্রধান উৎসব। এক বার বৈশাখী পূর্ণিমায় গঙ্গার উপরে নৌকায় সমাজবাড়ির চন্দনযাত্রার গানে বিভোর কালিকাপ্রসাদ সারারাত হাজির। ঘাটের সিঁড়ির ধাপে বসে গলা খুলে গান গাইছেন আর ফ্লাক্স থেকে লিকার চা খাচ্ছেন চিনি ছাড়া।

কালিকা যে ভাবনা মাথায় নিয়ে চলছিলেন, তার জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন অনেক বন্ধু। যত দিন না তাঁর নিজস্ব গবেষণা কেন্দ্র হয়, তত দিন পুরাতত্ত্ব পরিষদ ভবনের দরজা কালিকাপ্রসাদের জন্য ছিল অবারিত। মহাপ্রভু মন্দিরের পরিচালন সমিতির সম্পাদক জয়ন্ত গোস্বামী বলছেন, “কীর্তন সংরক্ষণের যে কাজ উনি করছিলেন, তা ভারী আশাপ্রদ। কিন্তু মহাপ্রভু এ কী করলেন?”

কালিকাপ্রসাদের মৃত্যুতে বাংলা কীর্তনের নষ্টকোষ্টী উদ্ধারের কাজও থমকে গেল, আপাতত।

ব্যক্তিগত বন্ধুতা ছিল না। তবু সকালেই হাউহাউ করে কাঁদছিলেন বহরমপুরের অলকানন্দা পাল। ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ছিল না, শুধু গান শুনেই কালিকার গুণে মজেছিলেন তিনি। কোনও রকমে বললেন, ‘‘উনি আর গাইবেন না, মানতেই পারছি না।’’

(সহ-প্রতিবেদন: শুভাশিস সৈয়দ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

kalika prasad Death
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE