Advertisement
০৫ মে ২০২৪
Women

সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে

সরকারি নথি জানাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০২১—এই পাঁচ বছরে রাজ্যের প্রায় দেড় লক্ষ মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। সিংহভাগ নিখোঁজ মহিলা দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

ছবি: রৌদ্র মিত্র।

সোহিনী মজুমদার
শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৩ ০৮:৫৪
Share: Save:

গণেশের গজমুণ্ড কী করে হল, তা নিয়ে নানা পুরাণের নানা মত রয়েছে। কখনও সূর্য আহত হওয়ায় দেব দিবাকরের পিতা কশ্যপের অভিশাপে তার মাথা কাটা পড়ছে, কোনও পুরাণের আখ্যান অনুযায়ী নিজের বাবার কোপেই ঘটছে তার মুণ্ডচ্ছেদ। তবে অধিকাংশ আখ্যানেই অতি আদরে, যত্নে লালন করা এই পুত্রটি পার্বতীর কোল খালি করে চলে যায়। পরে, এক হাতির মাথা জুড়ে পুনঃপ্রাণপ্রতিষ্ঠা হয় দেবীর আদরের ছেলের। এ গল্প সবার জানা।

বিঘ্ননাশক, হেরম্ব বা রক্ষাকর্তা, গণেদের অধিপতি এই ছেলে পুনর্জন্মের পরে গণেশ নামে পরিচিত। বিনায়ক বা গণেশ্বরও বলা হয়। তবে বিনায়ক বা গণেশ্বর অনেকে, তারা কোনও এক জন দেবতা নয়। মহাভারতের অনুশাসনপর্বে বলা হয়েছে, বিনায়ক এবং গণেশ্বররা মানুষের নানা কাজের সাক্ষী হয়ে থাকে। এই মহাভারতের মাধ্যমেই গণেশ যেন খুব বেশি করে ঢুকে পড়ে এই ভূখণ্ডের গৃহস্থের ঘরে ঘরে। মহাভারতের সুবিশাল কাহিনি কী করে লিপিবদ্ধ করবেন, তা নিয়ে চিন্তায় আকুল কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে ব্রহ্মা গণেশকে স্মরণ করার উপদেশ দেয়। ‘গণদের পথপ্রদর্শক’ গৌরী-তনয় ব্যাসের প্রার্থনায় রাজি হয়। লিপিবদ্ধ হতে থাকে সেই আশ্চর্য সাহিত্যকীর্তি।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মহাভারত বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ‘‘এর মধ্যে, হয়তো অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবেই, একটি ইঙ্গিত কি থেকে যায় যে, দীর্ঘকাল ধরে একটি অবিচ্ছিন্ন স্রোতের মতো করে গণ বা সাধারণ মানুষের কল্পনাই রূপ পেতে থেকেছে এই বিশাল মহাকাব্যে!’’

কিন্তু যে সাধারণ গণের জন্য কলম তুলে নিয়েছিল পুষ্টি, সিদ্ধি, প্রাচুর্যের এই দেবতা, সেই জনগণের জীবনে কোথায় প্রভাব তার? অমিত শক্তি, পাণ্ডিত্যের অধিকারী সেই রক্ষাকর্তা মূর্তি কি সাধারণের দুর্দশায় বরাভয় দিতে পারছে? বাঙালির ঘরে নেহাতই ঘরোয়া আচারে পূজিত এই দেবতা বাংলার বারোয়ারি মণ্ডপে উৎসবের আকারে পুজো পেতে শুরু করেছে বছর কয়েক হল। কিন্তু বাঙালি ঘরের দৈন্য দূর করতে পারছে? বাঙালি চিরকাল মা দুর্গা আর তার আদরের সন্তানদের পরিবারের এক জন বলে দেখেছে। অথচ, অভাবের অভিশাপে নিজেদের পরিবারে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে কত কত কন্যা, পুত্রসন্তানের শৈশব-কৈশোর, তার হিসেব কেউ রাখে না।

সরকারি নথি জানাচ্ছে, ২০১৭ থেকে ২০২১—এই পাঁচ বছরে রাজ্যের প্রায় দেড় লক্ষ মহিলা নিখোঁজ হয়েছেন। সিংহভাগ নিখোঁজ মহিলা দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। এই পাঁচ বছরে রাজ্যে দায়ের হয়েছে প্রায় হাজার খানেক নারী পাচারের অভিযোগ। এই নারীদের প্রায় সত্তর ভাগই নাবালিকা।

কীসের আকাঙ্ক্ষায় রোজ ঘরছাড়া হয় এত এত মেয়ে? একটু উন্নত জীবনযাত্রা, একটু স্বাচ্ছন্দ্য—এটুকুই। গ্রামের ছেলেরা যদি ভিন্ রাজ্যে কাজে গিয়ে পরিবারের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারে, তবে মেয়ে হয়ে সে কেন পারবে না! ‘লক্ষ্মী রুকসানারা/ আরও যত ঘরছাড়া/ ত্রস্ত ও দিশেহারা/ তখনই জাদুকরেরা/ নিমেষে বানিয়ে দেয়/ বাগানের ফুল/ ঠিক নির্ভুল/ এ ভাবে মেয়েরা সব একে একে/ ফুল হয়ে যায়’—মনে বেঁধে শহুরে চারণকবির পংক্তিগুলো। দু’টো রোজগার হবে, ঘরের চালটা মেরামত হবে, জীবনটা আর একটু সুখের হবে—এটুকুই তো চাহিদা। এই স্বপ্নটাই জাদুর মতো লাগে। যারা সামান্য আশা দেখায়, তাদের পিছনেই জীবনপণ করে ছুটে যেতে মন চায়। পরিচারিকার কাজ থেকে, নাচ-গান থেকে, বিয়ে করে সংসার পাতা—সমস্ত প্রস্তাবেই রঙিন দুনিয়ার হাতছানি দেখতে পায় হতভাগিনীরা। তার পর? আর কোনও দিন বাড়িতে তাদের ফোন আসে না। চিঠি না। সন্ধেবেলায় তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে না। ঘর আঁধার করে কোল ফাঁকা করে বসে থাকেন আর এক হতভাগিনী। মা।

সমাজের একটা বড় অংশ এখনও বিয়ে করে সংসার পাতাকে মেয়েদের অন্যতম কেরিয়ার বলে মনে করে। ছোট থেকে পরিবারে শেখানোও হয় তেমনটা। বছর খানেক আগেই শতাধিক নারী পাচারে অভিযুক্ত এক যুবককে গ্রেফতার করে উত্তরবঙ্গের পুলিশ। প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করে বিক্রি করে দিত সে মেয়েদের। জানা গিয়েছিল, তার পনেরো নম্বর বিয়েটি আটকে অবশেষে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যটুকু ঘরের ভেতরে থাকলে কাঙালের মতো আত্মবিসর্জন দিতে হয়তো ছুটতে হত না ওদের।

ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রবণতা থাকে সবচেয়ে বেশি যে বয়সে, সেই নাবালিকা বয়সেই স্বেচ্ছায় বা পরিবারের চাপে বিয়ে হয়ে যায়। আশা একটাই—ভাল থাকতে পারা। মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার এক হাই মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক জানাচ্ছেন তাঁদের নবম-দশম শ্রেণির অধিকাংশ ছাত্রীই বিবাহিত।

অভিভাবকদেরও কত দূর দোষ দেওয়া যায়! এ লেখা যখন লিখছি, তখনই শুনলাম ওই এলাকারই আর এক পরিবারের কথা। বিবাহবিচ্ছিন্না মা ছোট মুদির দোকান করে সংসার চালান। এক মেয়ে ১৫, আর এক মেয়ে ১৭। বড় মেয়ের প্রেমিক কেরলে চলে যাচ্ছে শ্রমিকের কাজে। একটা বছরের ব্যবধানের জন্য রোজগেরে পাত্র হাতছাড়া করা তাঁর কাছে যেন বিলাসিতা! বিয়ে দিয়ে দেন বড় মেয়ের। ছোট মেয়ের চিন্তাও তো রয়েছে! একা মা কত সামলাবেন! তিনি না থাকলে কে রক্ষা করবে ওদের! ওপর থেকে কি সুদূর মর্ত্যের ক্ষুদ্র গণমানুষের এই তুচ্ছ আর্তি শুনতে পান অসুরদলনী মা দশভুজা বা তাঁর বিঘ্নবিনাশক পুত্রটি?

বিয়ে নামক এই আপাত সুরক্ষিত সমাধানটি কত বালিকার জীবনে কাল হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। সপ্তাহ খানেক আগেই হরিহরপাড়ার সাহাজাদপুরে ঝুলন্ত দেহ মিলল প্রিয়াঙ্কা খাতুনের। নাবালিকা বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। পণের দাবিতে চলত অত্যাচার। শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে তাকে, অভিযোগ পরিবারের।

এই বাধ্যতার নাগপাশে শুধু কন্যাসন্তানরা জড়িয়ে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই। মা-বাবাকে প্রদক্ষিণ করেই জগৎ প্রদক্ষিণ করা হয়ে গিয়েছে বলে গণেশ মান্যতা পেলেও, বাংলার ঘরের ছেলেদের অপর পার্বতীপুত্র কার্তিকের মতো সদর্থেই জগৎ পরিক্রমায় না বেরনো ছাড়া উপায় নেই। কারণ, বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। ঘরে কাজ নেই। অথিমারির সময়ের কথা বাদ দিলেও, মুর্শিদাবাদের অন্যতম অর্থকরী ফসল পাট। অথচ, তাতেও এ বার এত কম রোজগার হযেছে যে, নিজের জমি ছেড়ে ভিন্ রাজ্যে কাজে চলে যাচ্ছেন ছেলেরা। কেরল, সুরাত, মুম্বই—প্রতিদিন বাস ছাড়ে গ্রাম থেকে। কোনও কোনও গ্রামের প্রায় এক-দেড়শো ছেলে কেরলেই থাকেন। দুই দাদাও সেখানে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করেন দেখে বাড়িতে ইদ কাটিয়ে ছোট ভাইও তাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলেন। সদ্য সংসার পেতেছেন। ডোমকলের কুপিলার নাসির হোসেন। বয়স তেইশ। বকরি ইদের আগেই চারখানা বাক্সে ঘরে ফিরল তাঁর পুড়ে খাক টুকরো টুকরো দেহাংশ। কাজে তেমন দখল ছিল না। প্লাইয়ের পরিত্যক্ত অংশাবশেষ পরিষ্কার করতে গিয়ে পা হড়কে প্রায় কুড়ি ফুট গভীর ছাই চাপা জ্বলন্ত অগ্নিগর্ভে পড়ে যান। কারখানার মালিক দুর্ঘটনা ধামাচাপা দিতে ভিতরে কোনও দেহ আছে, সে কথাই মানতে অস্বীকার করে। অবশেষে শ্রমিকদের আন্দোলনে পুলিশ নাসিরের দগ্ধ দেহ কুয়ো থেকে উদ্ধার করে। চোখ ফেটে জল গড়িয়ে পড়ে নাসিরের বাবার ভাঙা দু’গালে—বাইরে কাজের খোঁজে গিয়ে প্রাণ হারাল ছেলেটা, কোনও জনপ্রতিনিধি এসেও খোঁজ নেননি।

ছেলেমেয়ে ভরা সংসার নিয়ে আশ্বিনের এই সময়টা মা দুর্গা ঘরে আসে ঠিকই। তবে অভাবের তাড়ণায় সন্তানহারা সব মায়ের কান্না বোধহয় উৎসবের সমারোহ, ঢাকের বাদ্যির আওয়াজ ঠেলে তার কান অবধি পৌঁছয় না। নিজের আদরের ছেলেকে হারিয়ে আবার কোলে ফিরে পেয়েছিল। সমৃদ্ধি, প্রাচুর্যের প্রতিমূর্তি গৌরীতনয় সেই গণনায়কও কবিকল্পনাই থেকে যান। মনে পড়ে যায়, মহাভারতেই একাধিক অনাচার লিখতে গণেশ পূর্ব প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে একবারও কলম থামায়নি। অভিমন্যুর মৃত্যু বা দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সময়ও সে মাথা নিচু করে লিপিকারের ভূমিকা পালন করে গিয়েছে। চোখ তুলে তাকিয়েছিল কি? দেবতাজনিত দূরত্ব বজায় রেখেছিল। বাস্তবেও দেবতার সংসার আর মানুষের সংসারের ব্যবধান ঘোচে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Women Society
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE