Advertisement
০৫ মে ২০২৪

ভাদরের বোলানে সিঙ্গুরের স্বপ্নচ্ছায়া

২০০৬। সালে সিঙ্গুরের ঘটনা নাড়া দিয়েছিল নদিয়ার বোলান শিল্পীদের। তাঁরা গান বেঁধেছিলেন— “জমি নিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে এখন করি কী/ চাষআবাদ বন্ধ হলে আমরা খাব কী/ নগদ কড়ি ক্ষণস্থায়ী, এই আছে এই নেই/ সিঙ্গুরের জমি দেওয়ার পক্ষে আমরা কিন্তু নেই।”

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৪২
Share: Save:

২০০৬। সালে সিঙ্গুরের ঘটনা নাড়া দিয়েছিল নদিয়ার বোলান শিল্পীদের। তাঁরা গান বেঁধেছিলেন— “জমি নিচ্ছে, টাকা দিচ্ছে এখন করি কী/ চাষআবাদ বন্ধ হলে আমরা খাব কী/ নগদ কড়ি ক্ষণস্থায়ী, এই আছে এই নেই/ সিঙ্গুরের জমি দেওয়ার পক্ষে আমরা কিন্তু নেই।”

কাট টু— ২০১৬, ১৪ সেপ্টেম্বর। সিঙ্গুরে ওঁরা সামিল হতে পারেননি। কিন্তু দিনভর টিভির সামনে বসে গিলেছেন গোটা অনুষ্ঠান। বলছেন, ‘‘এ জয় আমাদেরও। জমির মর্ম তারাই বোঝে যাদের জমি আছে।’’

সিঙ্গুরের জমিহারা কৃষকের কান্নায় সে দিন ছলছল করেছিল নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ, হাঁসখালি, কালীনগর, নাকাশিপাড়া, তেহট্টের বহু কৃষকের চোখ। পেশায় ওঁরা চাষি। কিন্তু নেশায় বোলান শিল্পী। চার পুরুষ ধরে তাঁরা বোলান ও হোলুই শিল্পী। গান লিখে সুর দেন।

২০০৬ সালে ওঁরা বোলানে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন জমি কেড়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে। ওঁদের এ গান শুনে তখনকার শাসক বামফ্রন্ট খুশি হয়নি। পৌষে ওঁরা ডাক দিয়েছিলেন, “ও কিসান ধর নিড়ানি, মাঠের পানে চল/ মাঠ আমাদের রুজিরুটি মাঠ আমাদের বল।” বোলান গায়ক বুদ্ধীশ্বর ঘোষ বলেন, “যত দূর মনে হয়, আমাদের আগে আর কেউ এভাবে গান গেয়ে সিঙ্গুর আন্দোলনের সপক্ষে সওয়াল করেনি।” দশ বছর পড়ে সুপ্রিম কোর্ট যখন কৃষকের জমি নিঃশর্তে ফিরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়, বোলান গেয়েই উদ্‌যাপনে মেতে ওঠেন কৃষ্ণগঞ্জের বুদ্ধীশ্বর, বসুদেব, নারায়ন, হারু বা শ্রীমন ঘোষেরা।

পৌষমাসে হোলুই আর চৈত্রমাসে বোলান, লোকমুখে ‘বুলান’। ধুলো মাখা ফাটা পায়ে ঘুঙুর জড়িয়ে দল বেঁধে ঢোলকাঁসি নিয়ে পুরান থেকে রামায়ন, মহাভারত হয়ে কৃষ্ণলীলা, চৈতন্যলীলা এসবই ছিল বোলানের সাবেক বিষয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে
সঙ্গে বিষয় বদলেছে। গ্রামজীবনের অভাব-অভিযোগ থেকে শুরু করে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম।

অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বুদ্ধীশ্বর বলেন, “খেটে খাওয়া মানুষের গান হল বোলান। সত্যি কথা বলতে বোলান শিল্পী ভয় পায় না।’’ নিমাই, প্রাণকৃষ্ণ বা স্বপন ঘোষের মতো চার পুরুষের বোলান গায়কদেরও সেই একই কথা। সিঙ্গুর জমি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর এত খুশি কেন তাঁরা? উত্তরে ওঁরা বলেন, “আমরা তো সাত পুরুষের চাষা। জমি হারালে কেমন লাগে, সে ব্যথা শুধু সে-ই বোঝে যার জমি আছে। তাই জমি কেড়ে নেওয়ার দিনে প্রথম প্রতিবাদ আমরা করেছিলাম। আমাদের মতো করে। এখনও জয়ের আনন্দ নিজেরাই ভাগ করে নিচ্ছি নিজেদের মধ্যেই।”

বুধবার সিঙ্গুর উৎসব উদ্‌যাপনের মঞ্চে ওঁদের কেউ ডাকেনি। হয়তো সিঙ্গুর আন্দোলনের নেতানেত্রীরা জানেনই না ওঁদের কথা। তবু ওঁরা বেরিয়ে পড়েছেন। ঘুঙুরে তাল তুলে ফের গাইছেন “নগদ কড়ি ক্ষণস্থায়ী এই আছে এই নেই, সিঙ্গুরের জমি দেওয়ার পক্ষে আমরা নেই।”

ভাদরের ঘন কালো আকাশের নিচে ভরা চূর্ণী তীরে মেঘের গর্জনের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে বোলানের ঢোল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Singur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE