এ ভাবেই গঙ্গায় তলিয়ে যাচ্ছে পাড়। — নিজস্ব চিত্র
পাড়ে দাঁড়ালে এখন প্রায়ই কানে আসে মাটি ধসে পড়ার ঝুপঝাপ শব্দ। সামান্য ঢেউ তুলে কোথাও না কোথাও তলিয়ে যাচ্ছে পাড়। পাথুরে বাঁধনের বাধাও কাজে আসেনি।
এলাকার বাসিন্দারা জানান, গত পনেরো দিনে কম করেও বিঘা দুয়েক জমি গঙ্গাগর্ভে চলে গিয়েছে। আর একটু এগোলে নদীর গ্রাসে চলে যেতে পারে বহু পুরনো জগন্নাথ মন্দির, হনুমান মন্দির এমনকী চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমও।
সদ্য পেরোল চৈতন্য জন্মোৎসব। সেই খুশিতেই মেতে ছিল নবদ্বীপ। তাই ভাঙনের ভ্রূকুটি সে ভাবে কারো নজরে পড়েনি। কিন্তু নদীপাড়ের বাসিন্দাদের কাছে এ সব খুব চেনা বিপদসঙ্কেত। গত কয়েক দশকে এ ভাবেই গঙ্গার ভাঙনে হারিয়েছে বাড়িঘর, রাস্তা, মন্দির, স্কুল, বিঘের পর বিঘে জমি। বদলে গিয়েছে নবদ্বীপের মানচিত্র। প্রায় বছর চারেক পর আবার ভাঙন দেখে তাই আতঙ্ক দানা বাঁধছে প্রাচীন মায়াপুরে।
গরমের শুখা মরসুমে গঙ্গা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছিল। সেই আটের দশকের পর গঙ্গার জল এত নীচে নামেনি। এখন নদীতে খানিক জল এসেছে। সেই সঙ্গে শুরু হয়েছে ভাঙন।
নবদ্বীপের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রাচীন মায়াপুরের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম থেকে কিছুটা দূরে জগন্নাথ মন্দিরের পিছনে ভাঙন চলছে। পাশেই হনুমান মন্দির। ওই এলাকায় নদীর পাড়ের মাটি আলগা হয়ে খসে পড়ছে ক্রমাগত। পাড় থেকে একটু ভিতরে নদীর জল এক বিরাট বড় ব্যাসার্ধ নিয়ে জোরাল ভাবে পাক খাচ্ছে। যা দেখে চৈতন্য জন্মস্থান, ভূমাসুখ আশ্রম, জগন্নাথ মন্দির, নরহরি ধাম, মৌনিবাবা আশ্রমসহ প্রাচীন মায়াপুরের বিভিন্ন মন্দির প্রধানদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।
এলাকার বাসিন্দা এবং প্রাক্তন পুরপ্রধান বিদ্যুৎ ভৌমিক জানান, গঙ্গা যদি এ ভাবে এগিয়ে আসে তা হলে নবদ্বীপের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী জগন্নাথ মন্দির, হনুমান মন্দির রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। আর ওই মন্দিরগুলির পরেই শহরের উত্তরদিকের শেষ জনবসতি। কম করে পঁয়ত্রিশটি পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক বিদ্যুৎবাবুর কথায়, ‘‘এক সময়ে প্রায় পাঁচশো ঘর ওই এলাকায় ছিল। কিন্তু বারে বারে ভাঙনের পর এখন কয়েকটি পরিবারই টিঁকে আছে।’’
সেই সতেরো শতক থেকে বিভিন্ন সময়ে গঙ্গার গতিপথ বদল এবং ভাঙনের ফলে নবদ্বীপের মানচিত্রে বারবার বদল ঘটেছে। ১৯৮০ দশক থেকে নতুন ভাবে নবদ্বীপে উত্তর এবং পূর্ব দিকে ভাঙন শুরু হয়। তলিয়ে যায় একরের পর একর জমি, বসত বাড়ি, স্কুল, চিনির মিল, মন্দির, রাস্তা। এই ভাঙনে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শহরের উত্তর সীমায় অবস্থিত প্রাচীন মায়াপুর। সেই সময় থেকেই ওই এলাকায় দফায় দফায় গঙ্গার ভাঙন হয়েছে। জলে মানুষে লড়াইয়ে প্রতিবারই নদী কেড়ে নিয়েছে চৈতন্যধামের বেশ খানিকটা অংশ। শেষ বড় ভাঙন হয়েছিল ২০০৪ সালে।
ঘটনার গুরুত্ব বুঝে নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা জেলা সেচ দফতরের কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ বিষয়ে স্থানীয় কাউন্সিলর সুকুমার রাজবংশী বলেন, “সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়রেরা এসে দেখে গিয়েছেন। বর্ষার মরসুমে যাতে কোনও বড় বিপদ না ঘটে সে জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”
নদিয়া জেলা সেচ দফতরের এসডিও সুবীর রায় বলেন, “পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখে এসেছি। সব মিলিয়ে প্রায় সাতশো মিটার নদীর পাড় ভেঙেছে। নবদ্বীপের দিকে নদীখাতের গভীরতা মারাত্মক ভাবে বেড়ে গিয়েছে।”
কিন্তু কেন এমন হল?
সুবীরবাবু জানান, ‘‘নদীর জলস্তর অস্বাভাবিক রকম নেমে যাওয়ায় এই ঘটনা ঘটেছে।” ভাঙন ঠেকাতে নদীর বুকে একাধিক আঠারো ফুট লম্বা ‘স্পার’ তৈরি করার কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে যে সব জায়গায় জনবসতির সমান্তরালে ভাঙন হচ্ছে সেখানে বাঁশের খাঁচা করে বোল্ডার ফেলা হবে। জেলা সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, আপাতত তিনশো মিটার এলাকা জুড়ে ভাঙন রোধের কাজের জন্য এক কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা পাঠানো হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন যেহেতু সামনে বিধানসভা ভোট এবং রাজ্যে আদর্শ নির্বাচন বিধি কার্যকর রয়েছে, সেই অবস্থায় ভোটের আগে আদৌ এই কাজে হাত দেওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। নবদ্বীপের পুরপ্রধান বিমানকৃষ্ণ সাহা বলেন, “ভোটের জন্য নির্বাচন কমিশন সেচ দফতরকে এই কাজ করার অনুমতি দিচ্ছে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy