Advertisement
০৯ মে ২০২৪

ডাক্তার এসেছেন, তবু ফার্মাসিস্টই ডাক্তারবাবু

লাইনে দাঁড়িয়ে গজগজ করছিলেন বাসন্তী দাস। —‘‘দীপক ডাক্তারের আজকাল বড্ড গুমর। খানিক ওষুধ দিলে কী-ই বা এমন হতো।’’ দিন কয়েক ধরে কোমরের যন্ত্রণাটা ভারী ভোগাচ্ছে। বাসন্তী তাই ছুটে গিয়েছিলেন ‘দীপক ডাক্তারে’র কাছে। কিন্তু হাসপাতালে এখন ‘নতুন ডাক্তার’ এসেছে। দীপক ডাক্তার ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। জানিয়ে দিয়েছেন, ওঁকেই দেখাতে হবে।

ওষুধ লিখছেন ‘দীপক ডাক্তার’। — নিজস্ব চিত্র

ওষুধ লিখছেন ‘দীপক ডাক্তার’। — নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার
মাজদিয়া শেষ আপডেট: ২৯ মে ২০১৬ ০২:০৪
Share: Save:

লাইনে দাঁড়িয়ে গজগজ করছিলেন বাসন্তী দাস। —‘‘দীপক ডাক্তারের আজকাল বড্ড গুমর। খানিক ওষুধ দিলে কী-ই বা এমন হতো।’’

দিন কয়েক ধরে কোমরের যন্ত্রণাটা ভারী ভোগাচ্ছে। বাসন্তী তাই ছুটে গিয়েছিলেন ‘দীপক ডাক্তারে’র কাছে। কিন্তু হাসপাতালে এখন ‘নতুন ডাক্তার’ এসেছে। দীপক ডাক্তার ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁকে। জানিয়ে দিয়েছেন, ওঁকেই দেখাতে হবে।

আসলে লোকে তাঁকে বলে ‘দীপক ডাক্তার’। কিন্তু তিনি তো ফার্মাসিস্ট। নিয়ম অনুযায়ী তিনি ওষুধ দিতে পারেন না। কিন্তু কাকে বোঝাবেন সে কথা। গ্রামের মুখ্যু লোকগুলোর সেই এক কথা— ‘‘বাপু সে নতুন ডাক্তার এত দিন কোথায় ছিলেন! উনিই আমাদের ডাক্তার বলো ডাক্তার, ভগবান বলো ভগবান।’’

বানপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দীর্ঘদিন কোনও চিকিৎসক ছিল না। গ্রামের লোকগুলোকে বিনা চিকিৎসায় মরতে দেখে গলায় স্টেথো ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন ফার্মাসিস্ট দীপক ঘোষ নিজেই। সেই থেকে জ্বরজারি, পেট ব্যথা, কাঁটাছেড়া, সবেতেই ভরসা ‘দীপক ডাক্তার’। কিন্তু মাস তিনেক হল নতুন চিকিৎসক এসেছেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। নিয়ম অনুযায়ী, তাঁর উপস্থিতিতে দীপক রোগী দেখতে পারেন না।

নিয়মের কথা তুলতেই রে রে করে উঠলেন রোগীরা। —‘‘আজ যে বড় পাশ করা ডাক্তার দেখাচ্ছেন। এত দিন কে আমাদের চিকিৎসা করেছে? কে ওষুধ দিয়েছে? ওই দীপক ডাক্তারই তো। তা হলে এখন কেন ওষুধ দেবে না? তা ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলো তো দীপক ডাক্তারই ওষুধ দেয়?’’

এখনও সপ্তাহে তিন-চার দিন হাসপাতালের আউট-ডোরের রোগী দেখতে হয় দীপককেই। কারণ সপ্তাহে দু’দিনের বেশি আসতে পারেন না নতুন ডাক্তার অভিজিৎ বিশ্বাস। তবে তাঁরও কিছু করার নেই। বললেন, ‘‘ব্লক হালপাতালেও তো চিকিৎসকের সংখ্যা কম। তাই সেখানেও ডিউটি করতে হয়। আরও একজন ডাক্তার থাকলে ভাল হতো।’’

সীমান্তের গরিব মানুষগুলোর তাই এখনও বড় ভরসা দীপক ঘোষ। যতই বোঝানোর চেষ্টা করা হোক যে তিনি ডাক্তার নন, রোগী দেখে ওষুধ দিতে পারেন না, তাঁরা সে কথা মানতে নারাজ। তবে হ্যাঁ, নতুন ডাক্তারের উপর তাঁদের কোনও ক্ষোভ নেই। এটাও স্বীকার করে নিয়েছেন, ‘‘নতুন ডাক্তারও খুব ভাল। যত্ন করে নাড়ি টিপে ওষুধ দেন।’’

কাছেপিঠে হাসপাতাল বলতে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতাল। তাই গেদে, বানপুর, হরিশনগর এলাকার মানুষদের ভরসা বলতে এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। প্রায় ২০-২৫ হাজার মানুষ নির্ভর করেন। দিনে শ’দুয়েক মানুষ ভিড় জমান আউটডোরে। কোনও কোনও দিন ভিড় এত হয় যে রোগী দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে যায়। ১৩ শয্যার ‘ইনডোর’ আছে। রয়েছে লেবার রুমও। বছর পাঁচেক আগে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করে তৈরি করে হয়েছে বিল্ডিং। নার্স রয়েছেন পাঁচ জন। চিকিৎসক না থাকলে তাঁরাই নিজেদের মতো করে ডিউটি সাজিয়ে ২৪ ঘণ্টাই হাসপাতাল চালান। রাতবিরেতে প্রসূতি মায়েরা এলে সামলান দক্ষ হাতে। তবে অবস্থা জটিল হলে পাঠিয়ে দেন কৃষ্ণগঞ্জ গ্রামীণ হাসপাতালে। আগে যখন ডাক্তার ছিল না, তখনও অন্যান্য রোগীদের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা নেওয়া হতো। কিন্তু খুব গরিব রোগী হলে নিজের ঝুঁকিতে ইনডোরে রেখে চিকিৎসা করাতেন দীপকবাবু। গুরুত্ব বুঝে ওই হাসপাতালে একজন চিকিৎসককে পোস্টিং দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি যোগ দেননি।

এক জন ফার্মাসিস্ট তো রোগী দেখে ওষুধ দিতে পারেন না। নিয়ম নেই। তার পরও কেন তা করছেন? প্রশ্নটা শুনে কিছুটা গুটিয়ে যান দীপকবাবু। তার পর বলেন, ‘‘২৫ বছর ধরে হাসপাতালে চাকরি করছি। এখানকার মানুষ খুব গরিব। বাইরে গিয়ে চিকিৎসা করানোর মতো সামর্থ্য অনেকের নেই। তাই কোনও চিকিৎসক যখন থাকেন না, তখন ওই অসহায় মানুষগুলোকে ফিরিয়ে দিতে পারি না। নিজের বিদ্যা আর অভিজ্ঞতা থেকে ওষুধ দিই। এ ছাড়া তো কোনও উপায় নেই।’’

বছর কয়েক আগে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপের সময় দীপক ও নার্সদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা ভোলেননি এলাকার মানুষ। হাসপাতালের পাশের মার্টিয়ারি-বানপুর পঞ্চায়েত। উপ-প্রধান তৃণমূ‌লের প্রসেনজিৎ বিশ্বাস বলেন, ‘‘দীপকরা কোনও দিন চিকিৎসকের অভাব বুঝতে দেননি। নিজেদের মতো করে হাসপাতালের পরিষেবাকে টিকিয়ে রেখেছেন।’’

জেলার মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক তাপস রায় বলেন, ‘‘দীর্ঘদিন ওই হাসপাতালে চিকিৎসক ছিল না। তাই প্রাথমিক ওষুধ ওই ফার্মাসিস্ট দিতেন। ফলে তাঁর উপরে এলাকার মানুষের একটা ভরসা তৈরি হয়েছে। তবে আমরা আরও এক জন চিকিৎসকের জন্য স্বাস্থ্য ভবনকে জানিয়েছি। আশা করছি দ্রুত সমস্যার সামধান হয়ে যাবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

pharmacist Docter Patient
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE