Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

জগন্নাথের ভোগে পিৎজা-বার্গার

কী থাকে না মাসির বাড়ির ৫৬ ভোগে। গজা থেকে গাজরের হালুয়া, পাস্তা থেকে পায়েস, পিৎজা থেকে পুষ্পান্ন কিংবা পুডিং থেকে পান্তুয়া। বিস্কুট থেকে বাতাসা, কেক থেকে কচুরি।

রথের ছায়ায় বিকিকিনি। কৃষ্ণনগরের শক্তিনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

রথের ছায়ায় বিকিকিনি। কৃষ্ণনগরের শক্তিনগরে সুদীপ ভট্টাচার্যের তোলা ছবি।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৫ জুলাই ২০১৬ ০১:৩৩
Share: Save:

তিনশো পঁয়ষট্টির মধ্যে ন’টা মাত্র দিন। সোজা রথ থেকে উল্টো রথ। নিজের মন্দির ছেড়ে জগতের নাথ থাকেন গুন্ডিচায়। চলতি কথায় মাসির বাড়ি। রাজকীয় যাপন ছেড়ে ভক্তের ভিড়ে মিলেমিশে থাকার এই ক’টা দিনে তাঁর আদর যত্নের যাতে ঘাটতি না হয়, সে দিকে কড়া নজর ভক্তদের। তাই আয়োজন জগন্নাথের ৫৬ ভোগের। নামে ৫৬ ভোগ হলেও প্রতি দিনই পদের সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়ে যায়।

কী থাকে না মাসির বাড়ির ৫৬ ভোগে। গজা থেকে গাজরের হালুয়া, পাস্তা থেকে পায়েস, পিৎজা থেকে পুষ্পান্ন কিংবা পুডিং থেকে পান্তুয়া। বিস্কুট থেকে বাতাসা, কেক থেকে কচুরি। চাউমিন থেকে চপ। মাসির বাড়িতে জগন্নাথ দেবের ভোগের তালিকায় দেশি-বিদেশি হাজারো ব্যঞ্জনের এমনই সহাবস্থান এখন নবদ্বীপ বা মায়াপুরের মন্দিরগুলিতে। বরং জগন্নাথের ভোগে জন্য এমন দেশি-বিদেশি ব্যঞ্জনের আন্তর্জাতিক আয়োজন খুব কম জায়গাতেই হয়। নবদ্বীপ ও মায়াপুরের মঠমন্দির গুলি এই ক’দিন রকমারি ভোগের প্রস্তুতিতে ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে।

এখানে বহুমন্দিরেই জগন্নাথের মাসির বাড়ি বা গুন্ডিচা নেই। যেমন, মায়াপুরে ইস্কনের চন্দ্রোদয় মন্দিরে জগন্নাথদেব আসেন প্রায় পাঁচ কিমি দূরের রাজাপুরের জগন্নাথ মন্দির থেকে। প্রাচীন এই জগন্নাথ মন্দিরটি একদা ছিল ফটিক চট্টোপাধ্যায়ের। পুত্রসন্তানহীন চাটুজ্যেমশাই তাঁর মেয়েদের বিয়ের পর জগন্নাথের সেবাপুজোর ভার ইস্কনের হাতে তুলে দেন। সেই জীর্ণ মন্দির সংস্কার করে ইস্কন জগন্নাথের নিত্যসেবা এবং সাড়ম্বরে রথের আয়োজন করছেন নয়ের দশক থেকে। মায়াপুরে ইস্কনের মূল চন্দ্রোদয় মন্দিরে অস্থায়ী ভাবে গুন্ডিচা তৈরি করে সেখানে আট দিন ধরে সেখানেই জগন্নাথ দেবের বিশেষ পুজো হয়।

ছবিটা একই রকম গঙ্গার অন্য পাড়ে নবদ্বীপের বেশির ভাগ মন্দিরে। প্রাচীন মায়াপুরের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমের অস্থায়ী গুন্ডিচায় থাকেন বালকসাধুর সুপ্রাচীন রথটি। দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠের জগন্নাথ দেবের অবশ্য মাসির বাড়ি আছে। এই আট দিন তিনি থাকেন ফাঁসিতলার জগন্নাথ মন্দিরে। কোনও মাসির বাড়ি নেই, তাই সারদেশ্বরী আশ্রমের সন্ন্যাসিনীদের পরিচালিত রথযাত্রা শেষে ফিরে আসে আশ্রমেই। তবে সারা বছর জগন্নাথ দেব যে ঘরে থাকেন, এই আটদিনে বদলে যায় তাঁর ঘর। একতলা থেকে দোতলায় ওঠেন দেবতা। সেখানেই তাঁর মাসির বাড়ি।

গুন্ডিচা নেই তো কী? তা বলে মাসির আদরের কোনও ঘাটতি নেই। সোজারথ থেকে উল্টোরথ। কেমন বন্দোবস্ত থাকে জগন্নাথ দেবের ভোগের? উত্তরে ইস্কনের রমেশ দাস বলেন, “প্রতি দিন জগন্নাথ দেবকে ৫৬ রকম ভোগ দিয়ে পুজো করার কথা। তবে সেটা শুধু ৫৬ ভোগে আটকে থাকে না। হয়ে যায় ১৫৬ ভোগ। মন্দিরের তরফ থেকে ৫৬ ভোগ দেওয়া যেমন হয়, তেমনই ভক্তরাও এই ক’দিন জগন্নাথের জন্য নিজেরা নানা পদ রান্না করে আনেন। সব মিলিয়ে সে এক এলাহী কাণ্ড।” এ বারের ৫৬ ভোগে যেমন নতুন সংযোজন কাস্টার্ড ও ভেজ বিরিয়ানি।

মায়াপুরে স্থানীয় ভক্তদের মধ্যে একটা প্রথা চালু আছে, রথের এই ক’দিন ভক্তরা বাড়ি থেকে শুদ্ধাচারে নানা পদ রান্না করে জগন্নাথের জন্য নিয়ে আসেন। প্রতি দিন মধ্যাহ্নের ভোগে তা নিবেদন করা হয় জগন্নাথকে। এ জন্য ইস্কনের তরফে গুন্ডিচার এক পাশে কয়েক হাজার মাটির হাঁড়ি রেখে দেওয়া হয়। সকালে ভক্তরা সেই হাঁড়ি নিয়ে যান। তার পর বাড়িতে নিজেদের পছন্দ মতো পদ রান্না করে দুপুরে ওই হাঁড়িতে করেই জগ্ননাথ দেবকে নিবেদন করেন। প্রতি দিন এমন হাঁড়ির সংখ্যা হাজার ছুঁয়ে যায়। রমেশ দাসের কথায়, ‘‘প্রতি দিন ভোর সাড়ে চারটে থেকে শুরু হয়ে যায় ইস্কনে ভোগের আয়োজন। মোট চল্লিশ জন নানা দেশের বাসিন্দা নানা ধরনের পদ রান্না করতে শুরু করেন। বেলা বারোটার মধ্যে সব কিছু তৈরি হয়ে যায়। বিদেশি ভক্তরা পিৎজা, পাস্তা, পুডিং, কেক, চাউমিন এবং নানা ধরনের বিস্কুট তৈরি করেন জগন্নাথ দেবের জন্য।

নবদ্বীপের চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রম,সারদেশ্বরী আশ্রম বা দেবানন্দ গৌড়ীয় মঠে জগন্নাথ দেবের ভোগেও কার্যত একই রকমের প্রাচুর্য দেখা যায়। নবদ্বীপের মঠমন্দিরের প্রধানদের কথায়, ‘‘স্বয়ং চৈতন্যদেব জগন্নাথ দেবকে পুজো করতেন। ফলে তাঁকে নিয়ে নবদ্বীপের মঠমন্দিরে যে বিশেষ উন্মাদনা থাকবে এটা খুবই স্বাভাবিক।’’ বিশেষ পুজোপাঠ ছাড়াও তাই রথের ক’দিন প্রতিটি মঠমন্দিরে রকমারি ব্যঞ্জনের ব্যবস্থা হয়। চৈতন্য জন্মস্থান আশ্রমে যেমন অন্ন, পুষ্পান্ন, পরমান্নের পাশাপাশি জগন্নাথের প্রিয় পদের আয়োজন হয়। তেমনি সারদেশ্বরি আশ্রমে বিকেলের দিকে ভেজে দেওয়া হয় চপ বা মালপোয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pizza burger
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE