এ যেন ডাঙায় বাঘ, জলে কুমির!
এক দিকে, ক্রমাগত ভাঙছে গঙ্গার পাড়। আতঙ্কে ঘুম ছুটে গিয়েছে গঙ্গাপাড় লাগোয়া বাসিন্দাদের। এ দিকে, নিকাশি সমস্যার জেরে টানা বর্ষায় জলে থইথই করছে গোটা শহর। আবার চারদিকে যখন জল থইথই , তখন খাওয়ার জন্য পরিস্রুত পানীয় জল মেলে না। পয়সা দিয়ে কিনে খেতে হয় জল। সেই জলেও চলছে কারচুপি।
ধুলিয়ানের নিকাশির সমস্যা চিরদিনের। কোনও পরিকল্পনা ছাড়া গড়ে ওঠায় শহরে নিকাশি ব্যবস্থা তথৈবচ। তাই দু’ফোঁটা বৃষ্টি মাটিতে পড়তে না পড়তে রাস্তায় হাঁটুজল জমে যায়। বর্তমানে ২১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৮টি ওয়ার্ডের বেশির ভাগ এলাকাই জলের তলায়। অনুপনগর ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চারদিক জলে ভরে রয়েছে। বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতায়, সবে তো বর্ষা শুরু হয়েছে। ভরা বর্ষায় দুর্ভোগ আরও বাড়বে। তবে এর জন্য বর্তমান ও প্রাক্তন পুরকর্তারা সকলেই দুষছেন অপরিকল্পিত নগরায়নকেই। বর্তমান পুরপ্রধান তৃণমূলের সুবল সাহার মতে, ‘‘জলমগ্ন ওয়ার্ডগুলিতে যেসব ছোটখাটো নালা বানিয়ে নিকাশির ব্যবস্থা হয়েছে তা অবৈজ্ঞানিক। ফলে একটু বৃষ্টিতেই জল জমে যাচ্ছে। তা ছাড়া নিকাশি নালার উপর জবরদখল করে বহু নির্মাণ গড়ে তোলা হয়েছে।’’ তিনি জানান, গোটা ধুলিয়ান শহরের ২১টি ওয়ার্ডকেই নিকাশি নালার অধীনে এনে ১৮০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প রাজ্য সরকারের কাছে নাকি আগের পুরবোর্ড জমা দিয়েছিল। কিন্তু এখনও তার কোনও উত্তর আসেনি। আপাতত শহরের বিভিন্ন জায়গায় ১৫ দিন থেকে ১০টি পাম্প চালিয়ে জমা জল সরানোর চেষ্টা হচ্ছে। প্রতিটি ওয়ার্ডে ৩০-৫০ গাড়ি ঘিঁস ফেলা হয়েছে।
বৃষ্টির জলে যখন শহর ভাসছে তখন ধুলিয়ানের পুব দিকে বাড়ি, বাজার, মসজিদের দেওয়ালে ধাক্কা মারছে গঙ্গার জল। ইদের দু’দিন আগে থেকে শুরু হওয়া ভাঙ্গন আশঙ্কায় ফেলেছে প্রশাসন ও পুরকর্তাদের। খোদ সমসেরগঞ্জ ব্লকের বিডিও পার্থপ্রতিম দাস বলেন, ‘‘শহরের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের একটি মসজিদের পাকা দেওয়ালে গিয়ে যেভাবে ধাক্কা খাচ্ছে গঙ্গার জলের ঢেউ তাতে আশঙ্কা বেড়েছে।’’
ধুলিয়ান শহরের ঠিক সামনেই গঙ্গার বুকে গজিয়ে ওঠা বিশাল চরই যে ভাঙনের কারণ তা জানিয়েছেন জেলার সেচ দফতরের কর্তারা। সেচ দফতরের গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ দফতর তাই শহর রক্ষায় ১৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প রচনা করে রাজ্য সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। কিন্তু সরকারি অনুমোদন আসেনি। এর আগে গঙ্গা ভাঙনে তিন তিনবার অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে ধুলিয়ানের। তিনবারই নতুন করে তৈরি হয়েছে ধুলিয়ানের জনপদ। বিপদের কথা অজানা নেই পুরপ্রধানের। তিনি বলেন, ‘‘গঙ্গার নদী পাড়ের চারটি ওয়ার্ড কার্যত শহরের গার্ডওয়াল হয়ে ভাঙনকে আপাতত রুখে দাঁড়িয়েছে। বসতির এক মিটারের মধ্যে এসে ঠেকেছে নদী। সেই গার্ডওয়াল ধসে গেলে ধুলিয়ানকে বাঁচানো অসম্ভব হয়ে পড়বে।’’
ধুলিয়ানে পানীয় জলের সমস্যা দীর্ঘদিনের। বছর পঞ্চাশ আগে এক লক্ষ গ্যালনের একটি জলাধার তৈরি করেছিল পুরসভা। দু’টি পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভ থেকে জল তুলে পরিশোধন করে ছয়টি ওয়ার্ডে তা বণ্টনের ব্যবস্থা করা হয়। বর্তমানে ওয়ার্ড সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২১টি। জনসংখ্যা এক লক্ষ ছাড়িয়েছে। কিন্তু বাড়েনি জল সরবরাহের এলাকা। পুরসভার এই জলের সুযোগ পায় শহরের মাত্র ২৫ শতাংশ পরিবার। বাকিদের নির্ভর করতে হয় নলকূপের জলের উপর। জলস্তর যখন নেমে যায়, তখন পানীয় জলের অভাবে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে শহর জুড়ে।
সমস্যার এখানেই শেষ নয়। বছর পনেরো আগে ধুলিয়ান শহরের বিভিন্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ জল পরীক্ষা করে দেখা যায় জলে আর্সেনিকের মাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। কিন্তু আর্সেনিক মুক্ত পানীয় জলের ব্যবস্থা না থাকায় শহরের মানুষ সেই বিষাক্ত জল খেতে বাধ্য হচ্ছেন।
বছর পাঁচেক আগে ধুলিয়ানে কেন্দ্রীয় সরকারের ২২ কোটি টাকার একটি ‘সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’ তৈরির কাজ শুরু হয়। দু’বছরের মধ্যে সে কাজ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বার বার পুরবোর্ড বদল হওয়ায় জল প্রকল্পের কাজ থমকে রয়েছে। ওই প্রকল্প শেষ হলে ধুলিয়ানে পানীয় জলের সঙ্কট কমত। এ দিকে, পানীয় জলের এই অভাবের কাজে লাগাচ্ছে একদল অসাধু ব্যবসায়ী।
কী রকম?
ধুলিয়ানে এখন ২০ লিটারের ‘মিনারেল ওয়াটার’ জার বিক্রি হচ্ছে দেদার। ৩০-৩৫ টাকা দিলে মিলছে এমন জার। শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়িয়ে উঠেছে ‘মিনারেল ওয়াটার’ তৈরির কারখানা। কিন্তু বেশির ভাগেরই বৈধ কাগজপত্র নেই। ব্যুরো অব ইন্ডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডস সার্টিফিকেশন দফতরের নিয়ম অনুযায়ী, ২০০০ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে জারি করা আদেশ অনুসারে আইএসআই ছাপ ছাড়া কোথাও বোতল প্যাকেজিং জল তৈরি বা বিক্রি করতে যাবে না। অন্যথায় ভেজাল নিরোধক আইন প্রয়োগ করে মামলা করতে শুরু করতে পারবে পুলিশ। যেখানে কড়া শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু শহরে সে সবের বালাই নেই। গভীর নলকূপ থেকে জল তুলে সেই জল মিনারেল ওয়াটার বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে অভিযোগ। সাধারণত, জলের একটি বটলিং প্ল্যান্ট গড়তে ক্যাপাসিটি অনুযায়ী কম করে ২৫ থেকে ৩৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। সেখানে লাখ দুয়েক টাকা খরচ করে একটা ছোট খুপরি ঘরের মধ্যে চলছে বেআইনি জলের বটলিং প্ল্যান্ট। তাতে ২০ লিটার জারে জল ভর্তির খরচ পড়ছে বড় জোর ৪ টাকা। বহন খরচ ১ টাকা ধরলে ২৫ টাকাই তাদের পকেটে ঢুকছে।
পুরপ্রধানের অবশ্য আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘গঙ্গায় জল বেড়ে যাওয়ায় ‘সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট’-এর কাজ আপাতত বন্ধ রয়েছে। তবে আগামী গ্রীষ্মের আগেই ধুলিয়ানের সব জায়গায় গঙ্গার পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছে যাবে।’’
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ। subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান-www.facebook.com/anandabazar.abp বা চিঠি পাঠান এই ঠিকানায়— আমার শহর, নদিয়া-মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা ৭০০০০১
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy