Advertisement
২২ মার্চ ২০২৩

কনভেন্টে ধর্ষিত বৃদ্ধ সন্ন্যাসিনী

রানাঘাটের একটি কনভেন্টে রাতে পাঁচিল টপকে ঢুকে শুধু লুঠতরাজ নয়, স্কুলের সত্তরোর্ধ্ব ‘মাদার সুপিরিয়র’কে ধর্ষণও করল দুষ্কৃতীরা। আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই সন্ন্যাসিনীকে ভর্তি করানো হয়েছে রানাঘাট হাসপাতালে। শনিবার বিকেলে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। তবে, শুক্রবার রাতের ‘বিভীষিকা’ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

কাটছে না আতঙ্ক।

কাটছে না আতঙ্ক।

বিতান ভট্টাচার্য ও সৌমিত্র সিকদার
রানাঘাট শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৫ ০২:৪৯
Share: Save:

রানাঘাটের একটি কনভেন্টে রাতে পাঁচিল টপকে ঢুকে শুধু লুঠতরাজ নয়, স্কুলের সত্তরোর্ধ্ব ‘মাদার সুপিরিয়র’কে ধর্ষণও করল দুষ্কৃতীরা।

Advertisement

আশঙ্কাজনক অবস্থায় ওই সন্ন্যাসিনীকে ভর্তি করানো হয়েছে রানাঘাট হাসপাতালে। শনিবার বিকেলে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর অবস্থা স্থিতিশীল। তবে, শুক্রবার রাতের ‘বিভীষিকা’ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন। দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হবে জানিয়ে সিআইডি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

পুলিশের অনুমান, শুক্রবার রাতে পাঁচিল টপকে স্কুলে ঢুকেছিল জনা সাতেকের ডাকাত দলটি। স্কুলে ঢোকার পরে একমাত্র নৈশরক্ষীকে মারধর করে বেঁধে ফেলে তারা। তার পর ঢুকে পড়ে প্রশাসনিক ভবনে। সেখানে আলমারি ভেঙে তারা নগদ প্রায় ১২ লক্ষ টাকা, ড্রয়ারে থাকা ল্যাপটপ, ক্যামেরা লুঠ করে বলে অভিযোগ। দুষ্কৃতীদের পরের গন্তব্য ছিল, স্কুল-লাগোয়া সন্ন্যাসিনীদের আবাসন। সেখানে রান্নাঘরের দরজা ভেঙে ঢুকে দুষ্কৃতীরা সটান উঠে যায় দোতলায়। তিনটি ঘরে ছিলেন সন্ন্যাসিনীরা। দুষ্কৃতীরা দোতলায় উঠতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তাঁদের। বাধা দিতে গেলে দুষ্কৃতীরা তাঁদের মারধর করে বলে অভিযোগ। এই সময়েই এক দুষ্কৃতী চুয়াত্তর বছরের ‘মাদার সুপিরিয়র’কে একটি ঘরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। ভোর ৫টা নাগাদ দুষ্কৃতীরা মূল গেটের বাইরে তালা দিয়ে পালিয়ে যায়।

Advertisement

শনিবার ভোর থেকেই বাজতে থাকে স্কুল চত্বরের গির্জার ঘণ্টা। অবিরাম সেই ঘণ্টায় বিপদ-সঙ্কেত আঁচ করে আশপাশের পাড়া, এমনকী, দূরের গ্রামের মানুষজনও ভিড় করেন রানাঘাটের অদূরে গাংনাপুরের ডন বস্কো পাড়ার ওই স্কুলের সামনে। বন্ধ গেটে তখনও ঝুলছে দুষ্কৃতীদের লাগানো তালা। ভিতরে সদ্য দড়ির বাঁধন খোলা প্রহরী জয়ন্ত মণ্ডল আর সিস্টারদের হা-হুতাশ। এই অবস্থায় স্থানীয় বাসিন্দারাই তালা ভেঙে স্কুলে ঢোকেন। তার পর স্কুল চত্বরের জমায়েত থেকেই কয়েকশো গ্রামবাসীর প্রতিবাদ মিছিল যায় স্কুলের অদূরে রেললাইনের দিকে। দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবি তুলে জনতা বসে পড়ে শিয়ালদহ-রানাঘাট রেল লাইনে। অবরোধ শুরু হয় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কেও। বেলা সাড়ে ১০টা থেকে কার্যত স্তব্ধ হয়ে যায় উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগের মূল সড়ক। থমকে যায় ট্রেন চলাচলও।

ঘটনার খবর পেয়ে এ দিন সকালেই স্কুলে চলে আসেন নদিয়া জেলা পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ। খানিক পরে আসেন জেলাশাসক পি বি সালিম। বিকেলে অর্ণববাবু বলেন, “প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, দুষ্কৃতীরা ডাকাতি করতেই এসেছিল। ধর্ষণের ঘটনাটি আচমকাই ঘটে গিয়েছে।” তাঁর দাবি, স্কুলের সিসিটিভি-র ফুটেজ সংগ্রহ করে দুষ্কৃতীদের কয়েকজনকে শনাক্ত করা গিয়েছে। তাঁর ঘোষণা, “ওই ফুটেজ সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া হচ্ছে। তা দেখে কেউ দুষ্কৃতীদের সন্ধান দিতে পারলে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”

রানাঘাটের কনভেন্টের সিসিটিভিতে ধরা পড়েছে দুষ্কৃতীদের ছবি।

স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে অবশ্য পুরস্কার ঘোষণা নিয়ে তেমন উৎসাহ চোখে পড়েনি। বরং তাঁদের ক্ষোভ, দিন কয়েক আগে স্থানীয় কয়েক জন তোলাবাজ ওই স্কুলে এসে টাকা দাবি করলেও বিষয়টি নিয়ে মাথাই ঘামায়নি পুলিশ। আর্চবিশপ টমাস ডি সুজাও বিকেলে স্কুলে এসে প্রশ্ন তোলেন, “প্রশাসন ও সমাজের ভূমিকা খতিয়ে দেখা উচিত। কী ভাবে একটা স্কুলে এমন ঘটনা হয়?” ঘটনার নিন্দা করে ‘বঙ্গীয় খ্রিস্টিয় পরিষেবা’র পক্ষে হেরোদ মল্লিকেরও দাবি, পুলিশ নিরাপত্তার যথাযথ ব্যবস্থা করলে এই ঘটনা এড়ানো যেত।

ওই ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রী কড়া নির্দেশ দিলেও রাজনৈতিক চাপান-উতোর কিন্তু শুরু হয়েছে। তৃণমূলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় নাম না-করে ওই ঘটনার পিছনে বিজেপির ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বলছেন, “ধর্মের ভিত্তিতে সমাজকে বিভাজনের চক্রান্ত চলছে। এটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি নয়।” পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমও বলছেন, “এটা মানবিকতার উপরে অত্যাচার। ধর্মীয় উন্মত্ততা গোটা দেশেই চলছে। কিছু শক্তি সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানি দিচ্ছে।”

পুলিশ কিন্তু কোথাও কোনও রাজনৈতিক দলের জড়িত থাকার কথা বলছে না। ধর্মীয় বিষয় জড়িত আছে কি না জানতে চাওয়া হলে পুলিশ সুপার তা উড়িয়ে দিয়েছেন। বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্যের প্রশ্ন, “সমাজে উত্তেজনা ছড়াতে এমন মন্তব্য করাটা কী মন্ত্রীদের কাছে অভিপ্রেত?” পুলিশ যেখানে ঘটনায় ধর্মীয় কোনও সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না, সেখানে মন্ত্রীরা আগ বাড়িয়ে এমন মন্তব্য করছেন কেন? ফিরহাদের ব্যাখ্যা, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যে ধর্মীয় উন্মত্ততা চলছে এ ঘটনার উপরে তার প্রভাব থাকার সম্ভাবনা রয়েছে, এমনটাই বোঝাতে চেয়েছেন তিনি।

কংগ্রেস এবং সিপিএম আবার রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতিকেই দায়ী করছে। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “এ রাজ্য নিয়ে কথা হলেই ধর্ষণের কথা আগে আসে। বয়স্ক, নাবালিকা কেউ বাদ যাচ্ছে না।” বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র আজ, রবিবার রানাঘাটে যাচ্ছেন। তাঁর অভিযোগ, “তৃণমূল শাসনে এমন অনেক ঘটনাই ঘটেছে। কিন্তু বিচার পাওয়া যায়নি।”

স্কুল সূত্রের খবর, দিন সাতেক আগে স্থানীয় জনা পাঁচেক দুষ্কৃতী জোর করে স্কুলে ঢুকে কর্তৃপক্ষের কাছে কয়েক লক্ষ টাকা দাবি করে। এক শিক্ষক বলেন, “সে দিন দুষ্কৃতীরা হুমকি দিয়ে বলে, ‘লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করছিস। আমরা তো কিছুই পাচ্ছি না। ফল কিন্তু ভাল হবে না’। স্থানীয়দের অভিযোগ, বিষয়টি আদ্যোপান্ত জানিয়ে অভিযোগ করা হয় গাংনাপুর থানায়। পুলিশ গা করেনি। যে দুষ্কৃতীরা শাসিয়েছিল তারা সকলেই স্থানীয়। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, শাসক দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় পুলিশ ব্যবস্থা নিতে ‘সাহস’ করছে না। স্কুলের অধ্যক্ষা সন্ন্যাসিনী শান্তি বলেন, “আমরা নিরাপত্তহীনতায় ভুগছি। আর কিছু বলতে পারব না।” এ দিন সন্ধ্যায় গাংনাপুরে মোমবাতি মিছিল করে ওই স্কুলের পড়ুয়ারা। হাতে ছিল পোস্টার ‘এই ঘটনার বিচার চাই, পুলিশ তুমি উত্তর দাও।’

স্থানীয়রা পুলিশ ও প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগে সরব হলেও পুলিশ অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছে। গাংনাপুরের ওসি বাস্তব পাল বলেন, “দুষ্কৃতীদের টাকা দাবি করার কোনও অভিযোগ স্কুল কর্তৃপক্ষ করেননি। তাঁরা শুধু এক ছাত্রকে ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেওয়া নিয়ে এক অভিভাবকের সঙ্গে সমস্যার কথা উল্লেখ করেন।” এ দিন অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর সিআইডি তদন্তের ঘোষণার পরে এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সি ভি মুরলীধরন এবং এডিজি (সিআইডি) রাজীব কুমার ঘটনাস্থল ঘুরে দেখে জানান, সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “দুষ্কৃতীরা যে ভাবে ‘অপারেশন’ চালিয়েছে তা থেকে এটা স্পষ্ট, স্কুলটা তারা ভালই চিনত। কোথায় সিসিটিভি রয়েছে তা-ও তাদের জানা ছিল। সেই কারণেই বেশির ভাগ সিসিটিভি ক্যামেরা হয় ভেঙে ফেলা হয়েছে, না হয় তার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে।” দিন কয়েক আগে স্কুলে যে মোটা অঙ্কের টাকা এনে রাখা হয়েছিল তা-ও তারা জানত বলেই মনে করছে পুলিশ। সন্ন্যাসিনী শান্তি বলেন, “এই টাকা স্কুলের উন্নয়নের জন্য এসেছিল। দুষ্কৃতীরা কী করে তার খোঁজ পেল, বুঝতে পারছি না।”

কিন্তু ওই প্রবীণ মাদার সুপিরিয়রকে দুষ্কৃতীদের এমন নির্যাতনের বলি হতে হল কেন? জেলা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ‘মাদার সুপিরিয়র’ অত্যন্ত নিয়মনিষ্ঠ এবং কড়া প্রকৃতির। সম্প্রতি কয়েক জন রক্ষীকে তিনি বরখাস্ত করেছেন। চাকরি ছাড়ার আগে তারাও হুমকি দেয়।

এ দিন সন্ধ্যায় রানাঘাট হাসপাতালে শুয়ে নির্যাতিতা সন্ন্যাসিনী শুধুই বলে চলেছেন, “ঈশ্বর তুমি ওদের ক্ষমা করে দাও।”

ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.