Advertisement
১৭ মে ২০২৪

ঘরই পর হয়েছে রুকবানুরের

পড়ন্ত বিকেল।মেঠো রাস্তা ধরে লাল পতাকার মিছিলটা এগিয়ে যাচ্ছিল আশরফ ঘরামির বাড়ির সামনে দিয়ে। পাক্কা আড়াই বছর পর।

সুস্মিত হালদার
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৬ ০২:১১
Share: Save:

পড়ন্ত বিকেল।

মেঠো রাস্তা ধরে লাল পতাকার মিছিলটা এগিয়ে যাচ্ছিল আশরফ ঘরামির বাড়ির সামনে দিয়ে। পাক্কা আড়াই বছর পর।

হৃদয়পুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রধানের স্বামী সেই আশরফ, আড়াই বছর আগে সিপিএম কর্মী আশাদুল শেখকে খুনে নাম জড়িয়েছিল যাঁর। তার পরেও যিনি গ্রেফতার হননি, বরং আশাদুলের পরিবারই গ্রামছাড়া।

চাপড়ার সিপিএম প্রার্থী সামসুল ইসলাম মোল্লা বলছেন, ‘তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের সন্ত্রাস উপেক্ষা করে মানুষ রাস্তায় নামছেন। এটাই সুসংবাদ।’’

তৃণমূল নেত্রীর ‘আশীর্বাদধন্য’ রুকবানুর রহমানই এ বার ফের টিকিট পেয়েছেন। বিরোধী, এমনকী দলেরও একটা অংশের অভিযোগ, তাঁকে ঘিরে থাকে দুষ্কৃতীরা। তাঁর হাত ধরেই দুষ্কৃতীরাজের রমরমা হয়েছে।

যেমন, হরিদাস প্রামাণিক। প্রথম থেকে চাপড়ায় তৃণমূলটা করে আসছেন। ২০১১ সালে রুকবানুরের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। কলকাতা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রার্থীকে যখন দলেরই অনেকে মেনে নিতে পারছেন না, সব ঝড়ঝাপটা সামলে দিয়েছেন তৎকালীন ব্লক সভাপতি হরিদাস। এখন হাজার মাইলের দূরত্ব। এমনকী, রুকবানুরকে হারানোর জন্য তিনি নাকি সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়েও পড়েছেন। কেন?

হরিদাস বলছেন, ‘‘আমায় তো ওরা ডাকেনি! ডাকলেও যেতাম না। বিধায়ককে যারা ঘিরে থাকে, সেই সব দুষ্কৃতীদের সঙ্গে রাস্তায় বেরোলে আমারই সামাজিক সম্মান নষ্ট হবে।’’ একই ভাবে সরে গিয়েছেন শ্যামল বন্দ্যোপাধ্যায়, নাজিমুল হালসানা, বিমল দাস, ফজলুর রহমান, অলোক দত্ত, অমর সিংহ রায়েরা।

গত বার তৃণমূলের যে সব নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘গোঁজ’ দাঁড় করিয়ে রুকবানুরকে হারাতে চেয়েছিল, তেমনই অনেকে এখন তাঁর ঘনিষ্ঠ। বর্তমান ব্ল‌ক সভাপতি আব্দুল রসিদ মল্লিক সে সময়ে কংগ্রেসের ব্লক সভাপতি ছিলেন। তৃণমূলেরই একটি সূত্রের দাবি, তিনি ছিলেন সেই গোঁজ-চক্রান্তের দাঁড় করাতে চাওয়ার অন্যতম কারিগর। এখন রুকবানুরের কাছের লোক। যেমন সুকদেব ব্রক্ষ্ম, কাংলা শেখ, জেবের আলিরাও। সিপিএম প্রার্থীর কটাক্ষ, ‘‘পুলিশের খাতায় দাগি অপরাধীরা ঘিরে থাকে বিধায়ককে। ভাবছেন, ওদের দিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে ভোটে জিতবেন। সেটা হওয়ার নয়।’’

এক সময়ে চাপড়া কংগ্রেসের শক্ত ঘাঁটি ছিল। ২০০৮ সালেও পঞ্চায়েত সমিতি এবং একক ভাবে বেশ কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত দখল করেছিল তারা। পরে আব্দুল রশিদ মল্লিক, পরিমল বিশ্বাসেরা কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন। হরিদাসের সঙ্গে হাত মেলান পরিমল, রুকবাবুনের সঙ্গে রশিদ। চাপড়ায় তৃণমূল আড়াআড়ি ভাগ হয়ে যায়।

পরিস্থিতি হাতের বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছে বুঝে কালীঘাটে নিজের বাড়িতে বৈঠকে ডেকে রুকবানুর-বিরোধীদের মদন না দেওয়ার জন্য তদানীন্তন মন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাসকে কড়া বার্তা দেন দলনেত্রী। তার পরে কিছু দিনের জন্য অবস্থা কিছুটা শুধরোলেও সেই সন্ধি বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।

ভোটের পাটিগণিতও রুকবানুরের পক্ষে যাচ্ছে না। গত বারই কানের গোড়া ঘেঁষে, মাত্র ২৬০০ ভোটে জিতেছিলেন রুকবানুর। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত ভোটে ভরাডুবি হয়। তৃণমূলের ভোট নেমে আসে মাত্র ৩৩ শতাংশে। সিপিএম পায় ৪৪ শতাংশ, কংগ্রেস ১৮ শতাংশ। লোকসভা নির্বাচনে কিছুটা সামাল দিলেও তা জোটকে আটকানোর জন্য যথেষ্ট নয়। প্রশ্ন শুধু, বিজেপি-ভাঙা ভোট কোন দিকে যাবে? গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে যে বিজেপি ২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল, তারা লোকসভা ভোটে মোদী-হাওয়ায় পাওয়া ১৯ শতাংশ ভোট ধরে রাখতে পারবে, এটা ধরে নেওয়ার যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই। যদি ১৫-১৭ শতাংশ ভোট বিজেপির হাত থেকে বেরিয়ে যায়, তা কার ঝুলিতে গিয়ে পড়বে?

জোট নেতাদের দাবি, বিজেপির উত্থানে ক্ষতিটা যেহেতু তাঁদেরই বেশি হয়েছিল, ভোট ফিরলে তাঁদের লাভও বেশি হবে। জামরেডাঙা, ধবপুর, দৈয়েরবাবজারের মতো একাধিক এলাকায় বেশ কিছু বুথ আছে যেখানে পঞ্চায়েত ভোটে সিপিএম জয়ী হলেও লোকসভা ভোটে ‘লিড’ পেয়েছে বিজেপি। তৃণমূলের ভোট একই থেকে গিয়েছে। ওই বুথগুলোয় জোটপ্রার্থীই ফের ‘লিড’ পাবেন বলে সিপিএম নেতাদের আশা। এবং সে ক্ষেত্রে রুকবানুরের জেতা কার্যত অসম্ভব।

‘মিষ্টভাষী’ রুকবানুর অবশ্য মাথা ঠান্ডা রেখেছেন। বলছে‌ন, ‘‘যাঁরা আমার বিরোধিতা করছেন, তাঁরা যে কখনও তৃণমূল করতেন সেটা তাঁদের পাশের বাড়ির লোকও ভুলে গিয়েছে। জেলা পরিষদের ভোটে প্রার্থী হয়েও জিততে পারেননি!’’

কিন্তু কোন অঙ্কে?

তৃণমূলের নেতারা বোঝাচ্ছেন, পঞ্চায়েত ভোটে অপেক্ষাকৃত ফল খারাপ হলেও পরে সেটা সামলে নিয়েছেন তাঁরা। পরে একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত বিরোধীদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন। সিপিএমের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছেন পঞ্চায়েত সমিতিও। প্রশ্ন হল, জনপ্রতিনিধিরা এলেও তাদের সঙ্গে কর্মী-ভোটারেরা এসেছেন কি? তার সদুত্তর কিন্তু মিলছে না।

এই ফাঁকটা যে রুকবানুর নিজে বুঝতে পারছেন না, তা কিন্তু নয়। আর পারছেন বলেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হেঁটে চলেছেন গ্রামের পর গ্রাম।

রাত ৯টা।

ছোট আন্দুলিয়া গ্রামে প্রচার সেরে রুকবানুর গেলেন সীমান্তবর্তী ডোমপুকুর গ্রামে। মোড়ের মাথায় তখন শ’দেড়েক মানুষের ভিড়। তাঁকে নিয়ে মিছিল এগিয়ে চলেছে গ্রামের ভিতরে। পাশে স্ত্রী জাহিদা রহমান। প্রথম দিন থেকেই তিনি রুকবানুরের সর্বক্ষণের প্রচারসঙ্গী।

কত রাত অব্দি চলবে প্রচার?

ছ’টি বুথ এই গ্রামে, আড়াই ঘন্টা তো লাগবেই— জানালেন রুকবানুর। এত রাতে? ক্লান্ত লাগছে না? কপাল বেয়ে নেমে আসা ঘাম মুছে রুকবানুর বলেন, ‘‘না তো! বরং মানুষের সঙ্গে মিশতে ভালই লাগছে।’’

‘‘গত পাঁচটা বছর এর কানাকড়ি করলে এখন এত কষ্ট করতে হত না’’ —পিছন থেকে টিপ্পনি কাটেন এক ক্লান্ত কর্মী।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC assembly election
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE